বিংশ পর্বঃ কলকাতা টু ঢাকা (পরিসমাপ্তি)

শিয়ালদহ রেলস্টেশন 

শিয়ালদহ স্টেশনঃ(১৫/০৬/১৯)

অনেকবারই এখানে এসেছি। এই জায়গার নাম পশ্চিমবঙ্গের কত লেখকের বইতে পড়েছি। এটাকে দেখার পরে প্রথম রিএকশন - আরে এইতো সেই স্টেশন, অনিমেষ যেখানে মাধবীলতাকে ট্রেনে তুলে দিতে আসতো । এরকম কতশত গল্প, উপন্যাস মিশে আছে এই স্টেশনকে ঘিরে । ভালোই লাগে এরকম কোথাও যেতে, দেখতে যেসব জায়গার বর্ণনা খুব শুনেছি বা পড়েছি । অন্যরকম একটা ফিল কাজ করে এরকম ক্ষেত্রে ।

যাহোক, ফিল আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ পৃথক একটি ইস্যু এখানে । এই স্টেশনটি মোটেও কোন রোমান্টিক প্লেস না । বরং অসাবধানে মামু সাজার চান্স আছে যেকোন সময়ে । সেজন্য এই স্টেশনে এলে কখনো চিপায় চাপায় যাওয়া উচিত না । বেশ ইনসিকিউরড একটা স্টেশন মনে হয়েছে আমার কাছে । আমাদের আজকের প্ল্যান মূলত এখানে সারারাত আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে পরদিন ভোর চারটার বনগাঁ মেইলে চেপে বনগাঁ চলে যাওয়া। 

সম্মানিত পাঠকবৃন্দআপনাদের মনে হতে পারে আমরা কেনো আজকের রাতে হোটেলে থেকে পরদিন ভোরের ট্রেনে বনগাঁ হয়ে বর্ডারে গেলাম না  আসলে ১৬ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের ঢাকায় থাকাটা মূল লক্ষ্য ছিলো  হোটেলে থেকে পরদিন ভোরে রওনা হলে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বেনাপোল থেকে ঢাকার বাসে উঠতেই বেলা ১১ টা বেজে যেতো কমপক্ষে  তখন বাসে উঠলে ঢাকায় পৌঁছাতে রাত ১২ টা বাজতো  আরেকটা কথা হলোআমি যতদূর জানি সকাল ১০ টার পরে বেনাপোল থেকে পরবর্তী বাসগুলো ছেড়ে যায় বিকেলের দিকে  এর মানে ঢাকায় থাকতে হবে পরদিন ভোরে  এসব কিছু বিবেচনা করেই আমাদের প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করা। 

সবকিছু এর আগের বারের মতোই হচ্ছিলো । কিন্তু এবারও আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো । আগের বার যা দেখিনি আর কি । আগেরবার সারারাত স্টেশনে রিলাক্সে বসে আড্ডা দিয়ে সময় পার করেছি । কিন্তু এবার রাত ১২ টার পরে আর কাউকে স্টেশনের ভেতরে থাকতেই দিচ্ছিলো না প্রশাসনের লোকেরা । আমরা দুইজন সহ অসংখ্য মানুষ স্টেশনের বাইরে সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলাম । একটু পরে সিঁড়ি থেকেও তুলে দেয়া শুরু হলো । কি একটা বিশ্রী অবস্থা রে ভাই । যেখানেই যাই সেখানেই কেউ না কেউ উঠিয়ে দিচ্ছে । ভালো ঝামেলায় পড়ে গেলাম । মনে হচ্ছিলো হাওড়াতে থেকে গেলেই ভালো করতাম । এই ঝামেলাগুলো নিতে হতো না । অন্তত রাতটা আরামে কাটানো যেতো । কিন্তু এখানে তো যাচ্ছেতাই অবস্থা । আর মাত্র ৩-৪ ঘণ্টাই যেনো পার হচ্ছে না । একটা সময়ে গিয়ে স্টেশনের সামনে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সির পাশে দুই বন্ধু বসলাম । আমাদের মতো বহু স্থায়ী, অস্থায়ী মানুষ আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছিলো সেখানে । 

যাহোক, এভাবেই অনেক সময় চলে গেলো । এসব খ্যাচখ্যাচি ভালো লাগছিলো না আর । শরীরের উপরে দিয়ে বয়ে যাওয়া ধকল একটু একটু করে টের পাচ্ছিলাম । এতোদিন আনন্দে ছিলাম তো তাই টের পাইনি, এখন বিরক্তি এসে শারীরিক অবসাদকে আর দৃঢ় করে তুললো । এভাবে রাত তিনটা অবধি বাইরেই কাটালাম । এরপরে স্টেশনে ঢুকে বনগাঁ মেইলের টিকিট করলাম । ভোর চারটার সময় শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ অভিমুখে দিনের প্রথম ট্রেন ছেড়ে যায় । আমরা দুইজন সেটাতে চেপে বসলাম । সুফল ট্রেনে উঠেই সেই একটা ঘুম দিলো  । টানা দুই ঘণ্টা ও ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। আমি সিকিউরিটির কথা ভেবে জেগেই ছিলাম । ২ ঘণ্টা পরে বনগাঁ স্টেশনে দুই বন্ধু নেমে গেলাম । 

বেনাপোল টু ঢাকাঃ 

বনগাঁ থেকে বর্ডারের নরমাল অটো ভাড়া ৩০ রুপী হলেও আগেরবার এসে দেখেছি ভোরবেলা বনগাঁ থেকে বর্ডারের অটো ভাড়া হয়ে যায় ৫০ রুপী । অনেক ঝামেলা করেও সেবার খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি । তাই এবার আর সময় নষ্ট না করে জনপ্রতি ৫০ রুপী হারেই চলে গেলাম বর্ডারে । দ্রুত বর্ডারে যেতে পারলে সিরিয়ালে সামনের দিকে থাকা যাবে এটাই মূলত চিন্তা ছিলো । বর্ডারে গিয়ে আমাদের কাছে যে রুপীগুলো অতিরিক্ত ছিলো, সেখানে থেকে চকোলেট কিনে সব রুপী শেষ করে ফেললাম । আইন অনুযায়ী রুপী নিয়ে বর্ডার অতিক্রম করা নিষেধ । যদিও হরহামেশাই এই কাজটা মানুষজন করে থাকে । খুব প্রয়োজন না থাকলে কি দরকার একটা অহেতুক অবৈধ কাজ করা । একটু সচেতন হওয়া যেতেই পারে । 

যাহোক, এরপরে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম । সকাল সাত টার পরে ইমিগ্রেশনের কাজ শুরু হলো ।  আমরাও বেশ ইজিলি সাবলীলভাবেই ইমিগ্রেশনের সকল কাজ শেষ করে বর্ডার ক্রস করে চলে এলাম বাংলাদেশে ।  প্রতিবার বাইরে থেকে ঘুরে এসে দেশে প্রবেশ করলেই একটা অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করে । নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের আইডেন্টিটি । কি সুন্দর একটা বিষয় । পৃথিবীর সকল জাঁকজমক আর চাকচিক্য ম্লান মনে হয় নিজের মাটিতে পা রাখলে । দেশে প্রবেশের সবচেয়ে বড় যে সুবিধা, সেটা হলো এই পাসপোর্ট টা আর এতো আত্মা দিয়ে আগলে রাখতে হয় না । একটা ফ্রি মুড চলে আসে । দেশের মাটিতে পা দিয়েই ফোন খুলে বাংলাদেশী সিমটা ভরলাম । পাসপোর্ট টা প্যান্টের পকেট থেকে ব্যাগের মাঝে চালান করে দিয়ে চলে গেলাম বাস কাউন্টারে । 

সাড়ে সাতটা বাজে ।  দেশ ট্রাভেলসের আটটার বাসের দুইটা টিকিট কেটে ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে উঠলাম । বাস নির্বিঘ্নে চলা শুরু করলো । বাসে উঠেই লম্বা একটা ঘুম দিলাম । ঘাটে গিয়ে প্রায় চারঘণ্টা বাস দাঁড়িয়ে ছিলো । সেখানেই হালকা নাস্তা করলাম । ভারী কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না। ঢাকায় আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো । সারা রাস্তা ঘুমিয়েই এলাম । রাতজাগার ফলাফল অনেকটাই প্রশমিত হলো । গাবতলী বাসস্ট্যাণ্ডে নেমে যে যে যার গন্তব্যে চলে গেলাম আমরা । আর এর সাথে সাথে শেষ হলো আমাদের ১৯ দিনের  সেই বহুল আকাঙ্খিত কাশ্মীর-লাদাখ ট্যুরের । আমাদের এরকম একটি সুযোগ করে দেয়ার জন্য এবং সহি-সালামতে ঘরে ফিরে আসার তৌফিক দানের জন্য মহান আল্লাহ পাকের দরবারে অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি । 



আজকের খরচঃ(১৬/০৬/১৯)

১। শিয়ালদহ - বনগাঁ = ৪০ রুপী 
২। বনগাঁ-বর্ডার (অটো) = ১০০ রুপী
৩। বেনাপোল - ঢাকা = ৮৩৬ রুপী (১০০০ টাকা)   ১০০ টাকায় ৮৩.৬৫ রুপী হিসেবে 
৪। খাওয়া-দাওয়া = ১৬৪ রুপী (১৯৬ টাকা)

মোটঃ ১১৪০ রুপী  





তারিখ
খরচ(রুপী)
২৯/০৫/১৯
৪৫৫৪
৩০/০৫/১৯
৫৩৫
৩১/০৫/১৯
১৬৮০
০১/০৬/১৯
১৯১০
০২/০৬/১৯
১৭০৫
০৩/০৬/১৯
১২৮০
০৪/০৬/১৯
১৭২৫
০৫/০৬/১৯
১১১০
০৬/০৬/১৯
১৮২৫
০৭/০৬/১৯
২৪৭০
০৮/০৬/১৯
১২১০
০৯/০৬/১৯
২৬৬০
১০/০৬/১৯
৬১০
১১/০৬/১৯
৩৮৮০
১২/০৬/১৯
২১৯০
১৩/০৬/১৯
৮০০
১৪/০৬/১৯
১৮৭০
১৫/০৬/১৯
২৪০
১৬/০৬/১৯
১১৪০
মোট
৩৩,৩৯৪




১০০ টাকায় =৮৩.৬৫ রুপী হিসেবে
৩৩,৩৯৪ রুপী = ৩৯,৯২১ টাকা(২জন)
সুতরাং জনপ্রতি খরচ = ১৯,৯৬০ টাকা












পরিশিষ্টঃ 

অনেক কষ্ট করে প্রতিটা তথ্য-উপাত্ত এবং নির্দেশনা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি । আশা করছি যারা কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখে বেড়াতে যেতে ইচ্ছুক, তাদের খুবই উপকারে আসবে লেখাটি । তবে একটা কথা মনে রাখবেন, প্রতিটা ট্যুরই ইউনিক । কখনোই শতভাগ মিলবে না। সুতরাং আগে থেকেই সেই চিন্তাটা মাথায় রাখবেন । কাউকে অন্ধভাবে অনুকরণ করে ট্যুর না দেয়াই বেটার । এছাড়া আর যেকোন তথ্য প্রয়োজন হলে আমি তো Facebook - এ আছিই ।  ভারত ভ্রমণের অতিরিক্ত পিক দেখতে চাইলে আমার ফেসবুকে আপলোড দেয়া Discovering India অথবা Trip to Kashmir অথবা Trip to Dreamy Ladakh ভ্রমণের এলবামগুলো ঘুরে দেখতে পারেন । এছাড়া যেকোন প্রয়োজনে নক দিতে পারেন । বলে রাখি, মেসেঞ্জার ফিল্টারের মেসেজ সবসময় চেক করা হয় না । সেক্ষেত্রে ফেসবুকে আমার ভারত ভ্রমণের কোন একটা এলবামে কমেন্ট করে ইনবক্সে আসতে বললেই হবে ।

একটি বিশেষ অনুরোধ । পৃথিবীটা দিনদিন ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, তার বড় একটা কারণ হলো এই ট্রাভেলাররা । আমরা প্রকৃতির কাছে গিয়ে দিনদিন সেটাকে বিনষ্ট করার অশুভ খেলায় মেতেছি । প্লিজ ! একটু দেখুন না, গোটা দুনিয়ার ঠিক হওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি আর আপনি ঠিক হলেই দেখবেন অনেক কিছু ঠিক হয়ে যাবে । ঘুরতে গেলে আমরা অবশ্যই কোথাও নোংরা করবো না । সবসময় সবার সাথে হৃদ্যতা বজায় রেখে চলবো । দেশের ভাবমূর্তি বাইরে গিয়ে যাতে বিনষ্ট না হয়, সেদিকে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখবো ।  আপনার ট্যুর খুব সুন্দর, নিরাপদ এবং পরিবেশ বান্ধব হোক - শুভ কামনা । ভালোবাসা অবিরাম । 💗



আমি ফাহিম,
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়,
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ।






মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

একাদশ পর্বঃ ১২,৮২৭ টাকায় ১২ দিনে ঢাকা থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ (বিশেষ পর্ব)