উনবিংশ পর্বঃ দিল্লির সময়গুলো এবং দিল্লি টু কলকাতা

রাষ্ট্রপতি ভবন, দিল্লি


মানালি টু দিল্লিঃ(১২/০৬/১৯)

বিকাল সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মাঝেই মানালি থেকে দিল্লি অভিমুখে ছেড়ে গেলো আমাদের বাস । শুরু হলো নতুন আরেকটি লং জার্নি । আমরা দুই বন্ধু একদম পেছনের দুই আসনে বসে গেলাম । আমাদের আসনের সামনেই ছিলো বাসের দ্বিতীয় গেইট । মানালি থেকেই আবহাওয়া কিছুটা সহনীয় পর্যায়ের মনে হচ্ছিলো । ভালোই লাগছিলো এজন্য ।


মানালি থেকে দিল্লির রুট টা হলো -

মানালি - কুল্লু - মান্ডি - সুন্দরনগর - বিলাসপুর - রুপনগর - আম্বালা - কুরুক্ষেত্র - পানিপথ - দিল্লি 

সাধারণ এই বাসগুলো যাত্রাপথে লোকজন ওঠায়, দাঁড়িয়ে লোক নেয় । লোকাল বলতে যা বোঝায় আর কি । তবে সময় মেইনটেইন করে একদম ভলবোর মতোই । যাত্রী এলে উঠিয়ে নেয়, বাট কারো জন্য অপেক্ষা করে না । দুই বন্ধু বাসে উঠে মাত্র কেনা খাবারগুলো খেলাম । যাত্রাবিরতিতে কিছু খাওয়া-দাওয়া করলাম । গল্পে গল্পে এগোতে লাগলাম । একটু পরে গরম লাগা শুরু হলো । ধীরে ধীরে এই গরম টাই প্রকট হচ্ছিলো । বাস কোথাও একটু দাঁড়ালেই ঘেমে যেতাম গরমে । তখন চোখ বন্ধ করলেই চোখে বারালাচালা পাসের চিত্র ভেসে উঠতো । আহারে ! এই গরমের চেয়ে সেই ঠাণ্ডাই ভালো ছিলো - এমন মনে হচ্ছিলো । যাহোক, রাত ৮-১০ বাজতেই সুফল ঘুমিয়ে গেলো । আমার ভালো ঘুম হলো না । আমি কমই ঘুমিয়েছি । মানুষজন ওঠে, নামে, কে কি করে - এসবই দেখি আর কি । এরপরে আর আজকের বলার মতো গল্প বিশেষ কিছু নেই সত্যি বলতে । একসময় ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমরা দিল্লির কাশ্মীর গেটে চলে এসেছি ।


International Tourist Bureau, New Delhi Railway Station(13/06/19)

কাশ্মীর গেটে নেমে সেখানে থেকে অটোতে চড়ে চলে যাই নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনের পাহাড়গঞ্জ সাইডে । কারণ এখানেই আছে ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিস্ট ব্যুরো । আমরা এই রাস্তাটুকু বাসে আসার জন্য অনেক খোঁজ নিলাম, বাট অনেক ঝামেলা মনে হলো । আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। নাহলে ঝামেলা না করে কিছু টাকা বেশি গেলেও অটো নিয়ে চলে যেতে পারেন । যাহোক, আপনাদের জানিয়ে রাখি, এই রেলস্টেশনটি একটা সুবিশাল এরিয়া নিয়ে প্রতিষ্ঠিত । এর মূল গেট যে পাশে, পাহাড়গঞ্জ ঠিক অপজিট পাশে । আপনি মূল গেটে নামলে ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে হেঁটে আসতে আসতেই অন্তত ১৫ মিনিট লাগবে । সুতরাং আপনি অটোওয়ালাকে বলে দেবেন সে যাতে আপনাদের রেলস্টেশনের পাহাড়গঞ্জ সাইডেই নামিয়ে দেয় ।

পাহাড়গঞ্জে নেমে ঢুকে গেলাম ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে । আপনারা হুটহাট কিন্তু ডিরেকশন পাবেন না । সেক্ষেত্রে হুদাই একদিক দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করবেন না, কাউকে জিজ্ঞেস করে সঠিক দিকে যাবেন । এরপরে আমরা সেখানে থেকে ফরেইন কোটায় কলকাতার টিকিট কাটলাম । কলকাতার ফেয়ারলি প্লেসের মতো দিল্লির এই ট্যুরিস্ট ব্যুরো থেকেই ফরেইন কোটায় টিকিট ইস্যু করা হয় । আমরা ১৪ তারিখ বিকাল ৫ টা ৩৫ মিনিটের দিল্লি থেকে কলকাতাগামী পূর্বা এক্সপ্রেসের টিকিট পেলাম । জনপ্রতি ভাড়া গেলো ৮৮৫ রুপী ।


দিল্লির সময়গুলোঃ

পাহাড়গঞ্জের ওখানেই থাকার মতো অনেক হোটেল রয়েছে । সেখানে আমাদের ৮০০ রুপীতে এসি রুম অফার করা হয়েছিলো । কিন্তু আমাদের একটু অন্যরকম প্ল্যান ছিলো । আমাদের ইচ্ছে ছিলো আগের বারের মতো এবারও ওল্ড দিল্লি জামে মসজিদ এর কাছে থাকবো । কারণ সেখানে মুসলিম খাবার হোটেল আছে প্রচুর এবং খাবারের ভ্যারিয়েশনও রয়েছে অনেক । দিল্লির সময়টা পুরোটা খেতে খেতে কাটানোর প্ল্যান থেকেই মূলত এখানে থাকা । তাই সেখানে থেকে অটো নিয়ে চলে গেলাম ওল্ড দিল্লি জামে মসজিদের কাছে ।

এবার এসে হোটেল খোঁজা শুরু করলাম । অনেক খুঁজলাম । দিল্লির গরম টা অতিরিক্ত ছিলো । আজকে ভাবছিলাম ১০০০ এর মাঝে এখানে এসি রুম পেলে উঠে যাবো । বাট এসি কেনো, বাজেট রেঞ্জের মাঝে ননএসি রুমই পাচ্ছিলাম না। অনেক হোটেল খুঁজলাম । কাজ হলো না  । এবার বাধ্য হয়ে গতবার যে হোটেলে ছিলাম, সেখানেই ফিরে গেলাম । জনপ্রতি ২৫০ রুপী হারে রাতে থাকা এবং একটা পাসপোর্ট ইস্যু করতে ৫০ রুপী(একবার) । মোট ৩০০ রুপী জনপ্রতি । এরচেয়ে কমে আর কোন হোটেল ওল্ড দিল্লি মসজিদের আশেপাশে পেলাম না । তাই বাধ্য হয়ে সেটাতেই উঠে গেলাম ।

কিছু কথা শেয়ার করছি । ভারত থেকে মার্কেট করে নিয়ে যাবার জন্য দেশে থেকেই আমরা দুইজন ৫-৭ জনের কাছে অনেক টাকার বায়না পেয়েছি । তাই আমাদের উদ্দেশ্য এখন তাদের মার্কেট মানির উপরে ভ্যাট বসানো । সেই ভ্যাটের টাকায় দুইদিন দিল্লিতে খাওয়া-দাওয়া করবো । এজন্য মোট ১৫০০ রুপী বাজেট করেছিলাম । কিন্তু এখানে খাবারের দাম এতো সস্তা যে দুইটা দিন এতো এতো খেয়েও দুইজন মিলে ১২০০ রুপীর বেশি খেতে পারিনি । বলে রাখি, এই দুইদিনের খাবার খরচ টাই শুধু এই ট্যুরের সামগ্রিক খরচের সাথে এড করা হয়নি । এছাড়া আর কোন খরচ কোথাও সামান্যও কম বেশি করা হয়নি । একদম পারফেক্ট হিসাব এড করা হয়েছে । আর এই হিসেবগুলো সবই খরচ করার সাথে সাথে মোবাইলে নোট করে নেয়া হতো । সুতরাং হিসাব এলোমেলো হবার কোন চান্সই ছিলো না ।

যাহোক, সেই হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করলাম । বিকেলে মার্কেট করতে বের হলাম । অনেক কিছু কেনাকাটা করা হলো । সারাদিন এভাবেই কেটে গেলো । রাতে ফের খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, ঘুম ।

দিল্লি টু কলকাতাঃ(১৪/০৬/১৯)

আজকে কোন কাজ নেই । ঘুম থেকে উঠলাম ধীরে স্থিরেই । এরপরে শুধু খাওয়া-দাওয়া । সারাদিন ফ্রি থাকলেও কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছিলো না । আর দিল্লিতে অতিরিক্ত গরম থাকায় কিছু করতেও ভালো লাগছিলো না । মেয়েদের দেখতাম মুখ ওড়না দিয়ে ঢেকে রাস্তায় চলাচল করে । মনে হতে পারে তারা পর্দা করছে বোধহয় । ব্যাপার টা তা না, তারা বুকের ওড়নাটাই মুখে জড়িয়ে চলে যাতে রোদে মুখের ত্বকের ক্ষতি না হয় ।

হোটেল থেকে যথাসময়ে চেক আউট করে চলে গেলাম খেতে । খেয়ে দেয়ে চলে গেলাম নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে । কিছু সময় অপেক্ষা করার পরে চলে এলো আমাদের কাঙ্খিত পূর্বা এক্সপ্রেস । উঠে গেলাম তাতে । যথাসময়ে নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাওড়া অভিমুখে ছেড়ে গেলো আমাদের ট্রেনটি ।

এবারও আমাদের নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো । সেটা হলো আমাদের কাঙ্খিত বগিটি পড়েছে জেনারেল বগির ঠিক পাশেই । জেনারেল বগি ওভারলোড হয়ে সেখানে থেকে পাশের ২-৩ টি স্লিপার ক্লাস বগিতে অতিরিক্ত যাত্রীদের সেই চাপ ছড়িয়ে পড়ে । সুতরাং সেই স্লিপার ক্লাসের যাত্রীদেরও এজন্য ভুগতে হয় । আমরা যেদিন দিল্লি থেকে জম্মু যাই সেদিন এরকমই কোন একটা বগিতে করে গিয়েছিলাম । সেদিন ছিলাম জেনারেল টিকিটের যাত্রী, আজকে স্লিপার টিকিটের । সেদিন আমাদের উপস্থিতিতে কেউ বিরক্ত হয়েছিলো, আর আজকে আমরা বিরক্ত হচ্ছি । হিসাবগুলো কি সুন্দর না ?

যাহোক, এভাবেই যাত্রা শুরু হলো । আমরা রাতের খাবার মূলত দুপুরের খাবারের সময়ই পার্সেল করে নিয়েছিলাম । যাতে করে ট্রেনে অতিরিক্ত খরচ টা এড়াতে পারি । আমাদের সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশী কয়েকজনকে পেলাম সাথেই । তাদের সাথেই অনেক গল্প-গুজব হলো । আসলে এরকম ফরেইন কোটায় টিকিট কাটলে যে পাশের মানুষটি বাংলাদেশী হবে - এটা মোটামুটি এতোদিনের ভ্রমণে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে । কারণ হলো, এসব রুটে ফরেইনার বলতে বাংলাদেশীরাই সবচেয়ে বেশি । আর ফরেইন কোটায় যারা টিকিট কাটে তাদের আসনগুলো একই সাথে পড়ে যায় অনেকসময় ।

চারিদিকে যাত্রী দিয়ে ভরা । অনেক স্লিপারের সিটে অনেক জেনারেলের যাত্রী এক কোণায় ঝিমিয়ে যাচ্ছিলো । মেঝেতে, টয়লেটের সামনে শুধু মানুষ আর মানুষ । টয়লেটে যাবার দরকার হলে বিপদ হয়ে যায় । এভাবেই চলছিলো আমাদের কলকাতার দিকে ছুটে চলা । রাত হলো, কত স্টেশন এলো-গেলো, কত মানুষজন এলো গেলো... একসময় পার্সেল করে আনা খাবার খেয়ে দুইজনেই ঘুমিয়ে গেলাম ।


ট্রেনের সময়গুলোঃ(১৫/০৬/১৯)

দিনটাও শুরু হলো এভাবেই । অনেক বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম এসব মানুষজনের ঝামেলা এড়ানোর জন্য । তবুও চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ । এবার রাতটা পার হলো উত্তর প্রদেশের মধ্যে দিয়েই । খুশিই হয়েছিলাম এটা ভেবে যে যাক সেই বিশ্রী টাইপ গরম টা আর ফেস করতে হবে না অন্তত । কিন্তু আমি ভুলই ছিলাম । দিনের বেলা ট্রেন যখন বিহারের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছিলো তখন গরমে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো । মনে মনে ভাবছিলাম - কি একটা দেশ রে ভাই, এর এক প্রান্তে ঠাণ্ডায় জমে যাই তো আরেক প্রান্তে গরমে গলে যাই । তবে যখন গরমে গলে যাবার দশা হতো তখন চোখ বন্ধ করে প্যাংগং লেকে সকালের বাতাস, বারালাচালার স্নোফল, কেলং থেকে মানালিতে আসার সময়ে কাঁপুনি তোলা ঠাণ্ডার কথাগুলো ভাবতাম । এসব ভেবে কিছুটা হলেও মনে মনে ঠাণ্ডা ফিল নিতে পারতাম । এভাবেই সারাটাদিন চলে গেলো ।

ট্রেনের ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায়

সেভাবে ভারি কিছু খাওয়া হয়নি আজকে, হাবিজাবি এটা সেটা খেয়েই দিনটা কেটে গেলো আজকের । জার্নির শেষ দিকে এসব জেনারেল+স্লিপারের সংকর বগিগুলোর টয়লেট ব্যবহার করতে পারাটাও একটা চ্যালেঞ্জ মনে হয় । ভয়াবহ বিশ্রী একটা অবস্থা তৈরি হয় । কি যে বাজে এক্সপেরিয়েন্স আছে এসব নিয়ে তা আর নাই বললাম। কখনো আপনাদের সুযোগ হলে নিজেরাই দেখবেন নিশ্চয়ই । It was something hectic! এজন্য চেষ্টা করতাম জার্নির শেষদিকে টয়লেটে না যাওয়া লাগে, সেরকম কাজ করতে । যাহোক, এভাবেই একটা সময়ে আমাদের ২৪ ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমণ শেষ হলো । বিকাল ৬ টার দিকে চলে এলাম হাওড়া স্টেশনে ।

হাওড়াতে নেমেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম । ফ্রেশ হয়ে দুই বন্ধু অনেক্ষণ সেখানেই বসে ছিলাম । এই জার্নিটা কোনদিক থেকেই উপভোগ্য লেভেলের ছিলো না । স্রেফ বাড়ি ফেরা দরকার তাই ফিরছি টাইপ আর কি । আর এটা সত্যই বটে । সামনে তো আর নতুন করে ফিল করার কিছু নেই । সেই পুরনো রুট, পুরোনো জায়গা । ফেরার জন্য ফেরা । বরং এই সুন্দর সময়গুলো এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাবার জন্য কিছুটা আফসোসই হচ্ছিলো । অসাধারণ কিছু মেমোরি রেখে গেলাম । আহারে ! যতটা আশা করিনি, তারচেয়েও বেশি কিছু পেয়েছি এই সফরে । এভাবে অনেক্ষণ বসে ছিলাম হাওড়াতে । এরপরে রাত প্রায় ১০ টার দিকে সেখানে থেকে চলে গেলাম শিয়ালদা স্টেশনে ।


খরচঃ(১৩/০৬/১৯)

১। কাশ্মীর গেট - পাহাড়গঞ্জ(অটো) = ১২০/-
২। পাহাড়গঞ্জ - ওল্ড দিল্লি জামে মসজিদ = ৮০/-
৩। হোটেলে থাকা = ৬০০ /-

মোটঃ ৮০০ রুপী 




খরচঃ(১৪/০৬/১৯)

১। ওল্ড দিল্লি জামে মসজিদ - নিউ দিল্লি রেলস্টেশন(অটো) = ১০০/-
২। দিল্লি - কলকাতা (ট্রেন) = ১৭৭০ /-

মোটঃ ১৮৭০ রুপী 





খরচঃ(১৫/০৬/১৯)

১। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া = ২২০/-
২। হাওড়া - শিয়ালদহ (বাস) = ২০/- 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

কম খরচে সিমলা-মানালি ভ্রমণ