অষ্টাদশ পর্বঃ বাই রোড লেহ টু মানালি - ২

রাস্তায় বরফ সরানোর জন্য ব্যবহৃত বুলডুজার 

বারালাচালা টু কেলংঃ

ভেবেছিলাম এটাই সকল ঝামেলার শেষ । কিন্তু নাহ, আমরা ভুল ছিলাম । সামনে আমাদের জন্য আরো কিছু অপেক্ষা করছিলো । বারালাচালা থেকে কেলং ৭৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । এই দুই স্থানের মাঝে রয়েছে ক্রমান্বয়ে জিংজিংবার, পাটসিয়ো, দারচা এবং জিসপা । বারালাচালা থেকে প্রায় টানা আরো দুই ঘন্টা গাড়ি চললো । রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে তখন । স্থানটির নাম আমি উদ্ধার করতে পারিনি, তবে দারচার কাছাকাছি কোথাও এসে আবার ফেঁসে গেলাম । এবার অন্যরকমভাবে ফেঁসে গেলাম । বরফ গলা জল, যেটাকে গ্লেসিয়ার বলে সেই গ্লেসিয়ারের একটা ফ্লো চলে গেছে মূল রাস্তার উপর দিয়েই । এই জায়গায় সবসময়ই গাড়ি সমস্যায় পড়ে । প্রায় ৩০-৪০ ফিট দৈর্ঘ্যের রাস্তা আক্রান্ত , বাকি রাস্তা ওকে । কিন্তু এই সামান্য রাস্তাটুকুই আর পার হওয়া যায় না । পানির প্রবাহে রাস্তার অবস্থা একদম যাচ্ছেতাই । 

এখানেই ফেঁসে গিয়েছে(পিকটি সংগৃহীত)
আমাদের বহরের প্রথম গাড়িটি ঠিকভাবে জায়গাটুকু ক্রস করতে পারলেও দ্বিতীয় গাড়িটি আটকে গেলো সেখানে । গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে সেই আলোয় ড্রাইভাররা নেমে গেলো নতুন যুদ্ধে । প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে বহুসময় ধরে এই যুদ্ধ চললো । কতরকম কসরত শুরু করলো তারা । সামনের গাড়ির সাথে রশি বেঁধে যে পেছনের টা টেনে নেবে, এমন রশিও ছিলো না সাথে । অবশেষে তিন গাড়ির সবাই নেমে ঠেলাঠেলি শুরু করলাম । তবুও গাড়ি নড়ে না । ইট ওয়াজ সিরিয়াস । গ্লেসিয়ারের জল পায়ে লাগার সাথে সাথেই পা অবশ হয়ে যায়, এতো মারাত্মক ঠাণ্ডা । গাড়িতে বসে আবার পা ম্যাসাজ করি । আবার এসে সামনের গাড়ি ঠেলি সবাই মিলে । কাজ হয় না । এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়ে যায় । একটা সময়ে সবার প্রচেষ্টায় সামনের গাড়িটি এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় । এবার কোন রিস্ক নিলো না তৃতীয় গাড়িটি । রাস্তায় যথাস্থানে কিছু ইট, খোয়া দিয়ে সাবধানে একটানে পার করে ফেললো । যাক, নতুন করে আর কোন ঝামেলা হলো না দেখে ভালোই লাগলো । 

রাত দেড়টা বাজে প্রায় । সেখানে থেকে সামান্য একটু এগিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে আমাদের গাড়ি তিনটি থামলো । সম্ভবত দারচা তেই হবে হয়তো । হোটেলের সামনে দেখি অনেকগুলো বাইক রাখা । বাইকের উপরে দিয়ে বরফের স্তর জমে আছে । হোটেলের ভিতরে প্রবেশ করে ঘটনা বুঝতে পারলাম। ছাপড়া দিয়ে কোনভাবে থাকার একটা জায়গা বানিয়েছে । সেখানে এসে বিপদগ্রস্থ পথিক রাত্রিযাপন করে জনপ্রতি ২০০ রুপীর বিনিময়ে । অনেক মানুষজনকে দেখলাম লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে । সিস্টেম টা ভালো লাগলো বেশ । এরকম পথে একটা মানুষ কত বিপদে পড়তে পারে, এরকম সাধারণ ব্যবস্থাই অসাধারণ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে তখন । সেটা হয়তো রুপী দিয়ে মাপা যায় না ।

যাহোক, হোটেল দেখে এতোক্ষণে ক্ষুধা বোধটা একটু সজাগ হলো । সেই সাথে গরম গরম কিছু খাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। দোকানীকে বলে একটা নুডুলস নিলাম । ৫০ টাকা দাম নিলো । আহ! এমন পরিবেশে গরম গরম নুডুলস একদম অমৃতের মতো লাগছিলো । খেয়েই চাঙ্গা হয়ে গেলাম । সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে ফের আমাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করলো ।

এরকম পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় ড্রাইভাররা হেডলাইটের আলোয় যথেষ্ট ডেয়ারিং ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলো । মাঝে মাঝে আমার বেশ ভয়ই করছিলো । গাড়ি চালানোর একটু ১৯-২০ হলেই একটা যাত্রীও বাঁচানো সম্ভব হবে না, এমন সিচুয়েশন রাস্তার । তবে তারা ফাস্ট চালালেও রাফ না ।

যাহোক, মানালি পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি । কিন্তু আমরা তো কেলং নেমে যাবো, সেটা আর খুব বেশি দূরে নয় । জার্নির শেষ সময়ে এসে মনে হচ্ছিলো জার্নিটা শেষ না হলেই বোধহয় ভালো ছিলো । স্বপ্নের একটা রুট ছিলো, সেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে । এক্সপেরিয়েন্স এর একটা বস্তা জমে হয়ে গেছে একটা ভ্রমণেই । সারাজীবন মনে রাখার মতো কিছু ছিলো সেই সময়টা ।

যাহোক, আমাদের নামার সময় ঘনিয়ে আসতেই আরেকটা নতুন সমস্যা শুরু হলো । বৃষ্টি । ধুরু । হলো কিছু ! এই ঠাণ্ডার মাঝে আবার বৃষ্টি হলে আরো ঝামেলা বাড়বে । একসময় দেখি তিনটা গাড়িই মূল রাস্তা ছেড়ে সরু একটা রোডে নেমে গেলো । জিজ্ঞেস করলাম এই রাস্তা কেনো ? ড্রাইভার ভাই জবাব দিলেন - আপনাদের কেলং বাসস্ট্যান্ডে ড্রপ করতে যাচ্ছি । ভালোই হলো । মূল রাস্তায় নামিয়ে দিলে এই ঠাণ্ডা আর বৃষ্টিতে অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো । বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই কেলং বাসস্ট্যাণ্ডে নেমে গেলাম দুই বন্ধু । নেমে আমাদের গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিলাম । সেই তিন আংকেলের কাছে থেকে বিদায় নিলাম । প্রায় ৫ দিন একসাথে ছিলাম। অনেক সখ্যতা হয়ে গিয়েছিলো বয়জ্যেষ্ঠ এই তিনজনের সাথে । খারাপই লাগছিলো বিদায় নিতে । যাহোক, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে না থেকে তাদের বিদায় দিয়েই দুই বন্ধু ঢুকে গেলাম কেলং বাসস্ট্যাণ্ডে আর গাড়ি তিনটি ফিরে গেলো সেই মূল রাস্তা তথা মানালির দিকে ।


কেলং টু স্পিতি ভ্যালিঃ

তখন রাত তিনটা বাজে । প্রায় ২১ ঘণ্টা একটানা ট্যাক্সিতে বসে ছিলাম । আমাদের Keylong নেমে যাবার কারণ তো আগেই বলেছি । আমরা এখানে থেকে যাবো স্পিতি ভ্যালি । এজন্য আমাদের কেলং থেকে মানালি অভিমুখে আরো ৫২ কিলোমিটার পথ গিয়ে গ্রামফু নামের একটা জায়গায় নামতে হবে । গ্রামফু থেকে একটা রোড গেছে স্পিতি ভ্যালির দিকে, আরেকটা গেছে মানালির দিকে ।

আমরা সেই ট্যাক্সিতে করেই গ্রামফু অবধি যেতে পারতাম । বাট ট্যাক্সিতে গেলে গ্রামফুতে গিয়ে পৌঁছাতাম ভোর রাতে । সেখানে থেকে সেই সময়ে কিভাবে স্পিতি ভ্যালি যাবো, সেই ব্যাপারে স্বচ্ছ কোন আইডিয়া ছিলো না । তাই কেলং ই নেমে গেলাম । এটা ভেবেই যে এখানে থেকে নিশ্চয়ই কোন একটা ব্যবস্থা হবে ।

শেষ রাতের কেলং বাসস্ট্যাণ্ডে ঢুকেই দেখি রাজ্যের নীরবতা সেখানে । মানুষজন বাসস্ট্যাণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় ঘুমাচ্ছে । আমরাই দুইটা প্রাণী শুধু নড়াচড়া করছিলাম । অদ্ভুত একটা পরিবেশ, সাথে বাইরের বৃষ্টি । অন্যরকম একটা সময় । নিজের ঘর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের অজানা কোন শহরের একটা ছোট্ট বাসস্ট্যাণ্ডে আমরা দুই বন্ধু । সবকিছুই কেমন স্বপ্নের মতো লাগছিলো । টিপটিপ বৃষ্টি, মিষ্টি একটা চাঁদ, হিম ঠাণ্ডা আর নীরব একটা বাসস্ট্যাণ্ড... কেমন একটা ঘোর লাগানো পরিবেশ । কত স্বপ্ন ছিলো এই রোড ট্রিপকে ঘিরে, সেটা সত্য হলো - ভাবতেই ভালো লাগছিলো ।

যাহোক, বাসস্ট্যাণ্ডে এভাবে কতক্ষণ থাকা লাগবে বুঝলাম না । তবে কেলং বাসস্ট্যান্ড টাকে যতটা অবহেলা করেছিলাম, ততোটা অবহেলার না এটা । এখানে থেকে দিল্লি সহ বহু দূরের বাস ছেড়ে যায় ।আধাঘণ্টা পরে দুই চারজনকে নড়াচড়া করতে দেখলাম । তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের কাঙ্খিত গন্তব্যের ব্যাপারে । তারা জানালো চারটার সময় মানালির বাস ছেড়ে যাবে । সেটাতে করে গ্রাম্ফু পর্যন্ত গিয়ে সেখানে থেকে আলাদা ব্যবস্থায় যেতে হবে স্পিতি ভ্যালি তে । এতো ভোরে বাস ছেড়ে যাবে জেনে অবাকই হলাম একটু ।

বাসে উঠে বসলাম দুই বন্ধু । ঠিক চারটার সময় বাস কেলং বাসস্ট্যাণ্ড ছেড়ে চলে গেলো । বাসে যাত্রী খুব অল্প কয়জন । নীরবতা কাটিয়ে বাস এগিয়ে যেতে থাকলো মানালি অভিমুখে  ।  এবার আরেকটা নতুন সমস্যা শুরু হলো । সমস্যাটা ঠিক নতুন না, বাট পুরাতন সমস্যাটাই এবার তীব্রভাবে ধরা দিলো । সেটা হলো ঠাণ্ডা । লেহ থেকে কেলং অবধি আসতেও এতোটা কাহিল হয়ে যাইনি, যতটা এই বাসে চড়ে ফিল হচ্ছিলো । বাপরে বাপ ! একেতো বৃষ্টি, উপরন্তু চারিদিকে বরফ আর হিমেল হাওয়া । বাসের জানালা সব লাগানো থাকলেও কিভাবে বাতাস আসছিলো আল্লাহ মালুম । বাস খুব ধীরে ধীরেই চলছিলো । ব্যাগ থেকে সমস্ত কাপড় বের করে পড়েছি । তবুও অটোমেটিক ঠোঁট ভাইব্রেট করছিলো শীতের কারণে । এভাবেই আমাদের এই মন্থর জার্নি চলছিলো । দিনের আলো ফুটতে তখনো অনেক দেরি । সুফল দেখলাম ঘুমিয়ে গেছে । আমি সিকিউরিটির কথা ভেবে আর ঘুমাতে পারলাম না ।

কেলং থেকে গ্রামফুর দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার, ভাড়া জনপ্রতি ১০০ রুপী । কন্টাক্টর লোকটা ভালো ছিলো । তার সাথেই আমাদের বিস্তারিত প্ল্যান শেয়ার করলাম । তিনি বললেন এখন স্পিতি ভ্যালিতে যাওয়া নাকি ঠিক হবে না, নানা সমস্যা হতে পারে । কিজন্য জানিনা, ধীরে ধীরে নিজে নিজেই কিছুটা ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছিলাম । তবুও চিন্তা করলাম দেখা যাক, গ্রামফুতে নেমে গিয়ে বাকিটা ব্যবস্থা করা যাবে । কন্টাক্টর গ্রামফু থেকে স্পিতি ভ্যালি অভিমুখে যাবার পথে আমাদের নামিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সামনে গিয়ে বসলেন । আমরাও ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের পানে । সুফলকে ডাক দিয়ে মাঝে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে যাবি স্পিতি ভ্যালিতে ? সুফলও দেখলাম মিনমিন করছে ।

ভোরের আলো ফুটেছে ততোক্ষণে । একসময় গ্রামফুতে চলেও এলাম । কণ্টাক্টর আমাদের স্পিতি ভ্যালিতে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন । রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি ভাঙ্গাচোরা একটা রাস্তা চলে গেছে একদিকে, যেখানে কোন গাড়িঘোড়া নাই । রাস্তা দেখেই একধাক্কায় ডিমোরালাইজড হয়ে গেলাম । সাথে সাথে কন্টাক্টরকে বললাম - মামা যাবো না স্পিতি ভ্যালি, চলেন মানালি যাবো । সুফলও বলে বসলো - ধুরু প্যাংগং দেখলাম, লাদাখ দেখলাম ... গেলাম না তোর স্পিতি ভ্যালিতে ।


গ্রামফু টু মানালিঃ (১২/০৬/১৯) 

যেই কথা সেই কাজ । গাড়ি চলা শুরু করলো মানালি অভিমুখে । গ্রাম্ফু থেকে মানালি ৬৬ কিলোমিটার দূরত্ব, ভাড়া এজন্য জনপ্রতি আরো ১১০ রুপী করে দিলাম । অর্থাৎ কেলং থেকে মানালির ভাড়া হলো জনপ্রতি ২১০ রুপী ।

বেশ সকাল হয়ে গেছে । চারিদিকের দৃশ্যগুলোও খুব সুন্দর ছিলো সত্যি বলতে । আসলে সুন্দরের সমুদ্র থেকে ঘুরে এসেছি বলে মিষ্টি খেয়ে দই আর সেভাবে মুখে ধরছে না । মানালি দিয়ে লেহ অভিমুখে ঢুকলে দারুণ লাগতো এই দৃশ্যগুলোই । তবে সবকিছুর ভীড়ে শীতের জন্য কাঁপাকাপি কমেনি একটুও ।

কাঁপতে কাঁপতেই একসময় চলে এলাম রোহতাং পাসে। বারালাচালা দেখে এসেছি বলে রোহতাং পাসকে মনে মনে সেভাবে আর গুণিই নাই সত্যি বলতে । কিন্তু এখানে এসে দেখি ভিন্ন হিসাব । হ্যাঁ বারালাচালার মতো হয়তো না, কিন্তু এখানেও বিস্তীর্ণ বরফের ছড়াছড়ি । রোহতাং পাসের উচ্চতা প্রায় ১৩,০৫৮ ফিট । এখানে এতো বরফ থাকতে পারে, আইডিয়াও ছিলো না । এখানে আমাদের বাস অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো । তবে বাস থেকে নামার কোন ইচ্ছেই ছিলো না আমার। বাসে বসেই সব দেখলাম ।

রোহতাং পাস নিয়ে একটা তথ্য শেয়ার করি । এই পাসকে বলা হয় pile of corpses, এর মানে হলো মৃতদেহের স্তুপ । শতশত বছর ধরে কঠিন শীতে বরফের পথে চলাচল করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ এখানে মৃত্যুবরণ করেছে । তাই এটার এমন অদ্ভুত নামকরণ । এটা যথেষ্ট বিপদজনক একটি পাস । প্রতি বছর সাধারণত মে থেকে নভেম্বর অবধি এটা খোলা থাকে । 



যাহোক, রোহতাং পাসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ৮ টা থেকে ৯ টার মতো বেজে গেলো  । এখানে থেকে মানালি এখনো ৫২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । আরো যেতে হবে অনেকটা পথ । আমাদের প্ল্যান মানালি থেকে বিকেল চারটার দিকে ছেড়ে যাওয়া দিল্লিগামী বাস ধরা । অভিজ্ঞতার উপরে অভিজ্ঞতা । যা কখনো ভাবিনি, সেরকমই কিছু অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য । সেটা হলো ট্রাফিক জ্যাম । বাপরে বাপ ! মাথা খারাপ করা লেভেলের জ্যাম । সিরিয়াসলি আমি এই রুটে এমন জ্যাম কখনো কল্পনাও করিনি । গাড়ি একটু যায় তো আর নড়ে না । ঢাকার জ্যামের চেয়েও অনেক বেশি কিছু । ঠিক ঈদের সময়ে ঢাকা - টাঙ্গাইল মহাসড়কে গরু মরা জ্যাম পড়লে যেমন হয়, এটাও ঠিক তেমনই ছিলো ।


এসব জ্যাম পুরোপুরিই ট্যুরিস্টদের জন্য । সবাই আসছে রোহতাং পাস সহ মানালি বেড়ানোর জন্য । তবে আমি বিরক্ত হইনি, পাহাড়ে বাঁকে বাঁকে সুন্দরের ফাঁকে ফাঁকে এভাবে সুন্দর সারিবদ্ধ ভাবে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে ভালোই লাগছিলো । আমি সেখানে জ্যামের কিছু পিক সংগ্রহ করেছি, নিজে তুলিনি ।





সিরিয়াস লেভেলের জ্যাম । মানালির প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পটের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এই জ্যাম । ভয়াবহ অবস্থা রে ভাই । এখানে এসে ফের মনে পড়লো সেই সোনমার্গে বলা কথাটা । কি সুন্দর সবাই বরফের পাহাড়ে চড়ার প্রস্তুতি হিসেবে গামবুট, ট্রাউজার সহ বিভিন্ন পোশাক ভাড়া নিয়ে একটা ভাব ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কিন্তু কাশ্মীরে বরফের সমুদ্রে থেকেও এসব পোশাকের বিষয়ে কারো সেভাবে হেডেক নাই ।

যাহোক, এসব জ্যাম পেরিয়ে সত্যিই অনেক সময় লেগেছে আমাদের মানালিতে পৌঁছাতে । শেষ সময়ে মনে হচ্ছিলো দিল্লির বাসটাই বোধহয় মিস করে ফেলবো । সেই ভোর চারটার সময়ে বাসে চেপে কেলং থেকে ১১৮ কিলোমিটার দূরবর্তী মানালিতে পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগলো প্রায় ১২ ঘন্টার মতো । মানালিতে গিয়েই দিল্লির বাসের টিকিট ম্যানেজ করে ফেললাম, একদম শেষ আসন দুইটা আমরা দুইজন নিলাম । দুইজনের জন্য মানালি থেকে দিল্লির বাস ভাড়া গেলো ১৫৫০ রুপী । বিশ্রাম নেয়ার মতো সময়ই পেলাম না ।

মানালি বাসস্ট্যাণ্ডের পাশেই রয়েছে বনবিহার । গত বছর এখানে ঘুরে গিয়েছিলাম, খুব ভালো লেগেছিলো । তাই যখন আমাদের স্পিতি ভ্যালি যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে গেলো তখন গ্রামফুতে থাকতেই আমি আর সুফল মিলে প্ল্যান করেছিলাম মানালি গিয়ে বাসের টিকিট কেটে খেয়েদেয়ে আমরা বাকি সময়টা বনবিহারে কাটাবো । হাতে অনেক সময় থাকবে এটাই আমাদের ধারণা ছিলো । কিন্তু বাস্তবে সিচুয়েশনটা এমন একটা অবস্থায় চলে গেলো যে খাওয়ার সময় টা অবধি হলো না । কোন মতে দোকান থেকে কিছু পাউরুটি, বিস্কিট সহ কিছু খাবার কিনে উঠে গেলাম বাসে ।

মানালি-দিল্লি রুটে চলা এই HRTC বাস সম্পর্কে আইডিয়া আগে থেকেই ছিলো আমাদের । মানালি থেকে দিল্লির দূরত্ব ৫৭০ কিলোমিটার; ভাড়া জনপ্রতি ৬৭০ রুপী । আমাদের একটু বেশি লেগেছে আলাদা কারণে । খুবই সাধারণ একটি বাস । সিটগুলো সব সোজা । রিলাক্স টাইপ না ।   আরামপ্রিয় মানুষ হলে এই বাসে চড়ে যেতে পারবেন না । কারণ এটা একটা বিশাল জার্নি । প্রায় ১৬ ঘণ্টা লাগে দিল্লি গিয়ে পৌঁছাতে । আপনারা চাইলে ভলবো বা বিজনেস ক্লাস টাইপ বাসেও যেতে পারেন । ভাড়া ১২০০-১৫০০ রুপী । আমাদের দেশের অনুপাতে ভাড়া যথেষ্ট রিজনেবল ।


খরচঃ(১১/০৬/১৯)

১। লেহ - কেলং (ট্যাক্সি ভাড়া) = ৩৬০০/-
২। খাওয়া = ২৮০/-


মোটঃ ৩৮৮০রুপী 




খরচঃ(১২/০৬/১৯)

১। কেলং - মানালি = ৪২০/-
২। স্ন্যাক্স = ২২০/-
৩। মানালি - দিল্লি = ১৫৫০/-


মোটঃ ২১৯০রুপী







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

একাদশ পর্বঃ ১২,৮২৭ টাকায় ১২ দিনে ঢাকা থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ (বিশেষ পর্ব)