মেঘালয় সফরনামা

মেঘালয় সফরনামা


প্রারম্ভিকাঃ 

মেঘালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম ২০১৮ সালের ১৪ আগস্টে । গিয়েছিলাম তিন বন্ধু মিলে । ঢাকা থেকে ৬ দিন ৭ রাতের এই সফরে আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছে ৮,৮৭০ বাংলাদেশী টাকা । যারা খুব কম খরচে মেঘালয় সফরে আগ্রহী, তাদের কথা মাথায় রেখে আজকের ব্লগে সেই ট্যুরের আদ্যোপান্ত তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য ।  সেই সাথে আপনারাও পেয়ে যাবেন বাজেট মেইনটেন করে পার্ফেক্ট ট্রিপের একটা ডায়াগ্রাম । আমি নিজে অসংখ্য জায়গায় ঘাঁটাঘাঁটি করে যত তথ্য পেয়েছি, প্রাসঙ্গিক যত মানুষের সাথে কথা বলেছি, সেই সাথে নিজে ঘুরে এসে যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি, তার একটা সমন্বিত ফসল হলো আজকের এই লেখা । সুতরাং একটু দীর্ঘ হলেও কষ্ট করে পুরো ট্রিপের গল্পটা পড়ুন । আমি আশাবাদী এই একটা লেখাই মেঘালয় ট্রিপ নিয়ে আপনার জ্ঞানের পূর্ণতা এনে দেবে ।


মেঘালয়(Meghalaya): 

মেঘ+আলয়= মেঘালয় । এখানে আলয় শব্দের অর্থ হলো আবাস । সুতরাং সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত সম্পূর্ণ এই শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় "মেঘের আবাস" । কি দারুণ একটা নাম তাইনা ? নামের মধ্য দিয়েই যেনো ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যটা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । ব্রিটিশরা মেঘালয়ের রুপে মুগ্ধ হয়ে তাই এর নাম দিয়েছিলো "স্কটল্যাণ্ড অব দ্যা ইস্ট" । মেঘালয়ের প্রেমে আমি এতোটাই পাগল হয়েছি যে জানিনা স্কটল্যাণ্ড আদৌ মেঘালয়ের চেয়ে ভালো লাগবে কিনা ! স্কটল্যাণ্ড ঘুরে যদি এতোটা ভালো না লাগে তাহলে সেদিন আমি স্কটল্যাণ্ডের নামকরণ করবো "মেঘালয় অব দ্য ওয়েস্ট"। 

১৯৭২ সালে আসাম থেকে তিনটা জেলা নিয়ে গঠিত হয় মেঘালয় প্রদেশ । বর্তমানে এর জেলা সংখ্যা ১১ টি । মেঘালয়ের রাজধানী হলো শিলং এবং অফিশিয়াল ভাষা হলো ইংরেজি । ২২,৪৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট রাজ্যটি ভারতের ৭ম ক্ষুদ্রতম প্রদেশ যার মোট জনসংখ্যা হলো প্রায় ৩২,০০,০০০ । মেঘালয়ে এখনো মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান । এদের পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা সমুদয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয় এবং সে তার বাবা-মা এর দেখাশোনা করে ।  

উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ প্রদেশকে একসাথে বলা হয় সেভেন সিস্টার্স । মেঘালয় হলো সেই সেভেন সিস্টার্স এর একটা । ভারতের সবচেয়ে শীতলতম এই প্রদেশের প্রায় ৭০ ভাগই বৃক্ষ আচ্ছাদিত । সেই সাথে এখানেই রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং । মেঘালয়ের অন্তর্গত চেরাপুঞ্জির রয়েছে পৃথিবীতে সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের খেতাব । এছাড়াও অসংখ্য প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর একটা নৈসর্গিক প্রদেশ এই মেঘালয় । প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক আসেন এই সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যেতে । ট্যুরিজমকে ফোকাস করে মেঘালয়কে প্রধানত তিনটা মেজর অংশে ভাগ করা হয়ে থাকে । যথাঃ ১। ডাউকি, ২। শিলং এবং ৩। চেরাপুঞ্জি । এই তিনটা ভৌগোলিক অংশেই রয়েছে বাকি সব দর্শনীয় স্থানগুলো । 

ট্রায়াঙ্গল শেপে দেখলে একটা ত্রিভুজের তিন কোণায় এই তিনটা স্থানের অবস্থান 



আমার মেঘালয় ভাবনাঃ

আমার ধারণা অধিকাংশ বাংলাদেশী নাগরিকদের ট্রাভেলিং এর হাতেখড়ি হয় সিলেট ট্রিপের মধ্যে দিয়ে । টু বি মোর স্পেসিফিক ইট উইল বি জাফলং । আজকে যে বাংলাদেশীকে দেখবেন টেমস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছবি আপলোড দিচ্ছে, তাকে জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে অনেক ছোটতে বাবা-মায়ের হাত ধরে সে প্রথমে জাফলং বেড়াতে এসেছিলো । অথবা জীবনের প্রথম ট্রিপ হিসেবে স্কুল/কলেজ থেকে সবাই দল বেঁধে গিয়েছিলো জাফলং ।  আর জাফলং ভ্রমণ মানেই এক বুক আফসোস নিয়ে ফিরে আসা । কারণ...? সিম্পল ! সব সুন্দর সুন্দর পাহাড় আর ঝর্ণাগুলো পড়েছে ভারতের মধ্যে, আর বাংলাদেশের অংশে যতোটুকুও বা পড়েছে তার সবটাই পাথর ব্যবসায়ী সিণ্ডিকেটের তোপানলে পড়ে একদম ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা ! আমি প্রায় ৭-৮ বার জাফলং গিয়েছি । প্রতিবারেই বুক ভরা আফসোস আর শূণ্যতা নিয়ে ফিরে এসেছি । বন্ধুদের সাথে জাফলং দাঁড়িয়ে থেকে গুণতাম মেঘালয়ের ওই পাহাড়গুলো । পিছনের পাহাড়টা আরো বড়, তারপরের টা আরো বড়... আরো বড়, আরো বড় আর ঝাপসা । দৃষ্টির সীমানা আটকে যায় ... কিন্তু পাহাড় শেষ হয়না । সবমিলিয়ে শুরু থেকেই অদম্য কৌতূহল... কি আছে পাহাড়গুলোর ওই পাশে !  জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম সেই সাসপেনশন ব্রীজ । একদিন ওই ব্রীজের উপরে উঠে ছবি তুলবো, একটা ছোট্ট নিষ্পাপ স্বপ্ন ! সত্যি সত্যি যেদিন ওই ব্রীজের উপরে দিয়ে হেঁটে গেলাম... ইট সিমস লাইক আই কনকুয়ার মাই ড্রিম । আমার ধারণা শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে যেদিন ছবি তোলার সুযোগ হবে, সেদিনও এতোটা ভালোলাগা কাজ করবে না । জাফলং এর মতো ধুলি ধূসরিত, ময়লায় ভরা একটা জায়গার কিছু দূরেই নাকি এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম ! শুনে অবাক হয়ে যেতাম । উমগট রিভারের স্বচ্ছ পানি, লিভিং রুট ব্রীজ, স্নোনেংপেডেং গ্রাম আর ইয়া পেল্লাই সব ঝর্ণা... প্রতিনিয়ত এসব পিক দেখতাম ফেসবুকে । আর সেই সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের তকমা...  সব মিলিয়েই কত জল্পনা-কল্পনা ছিলো মেঘালয়কে ঘিরে... এই ট্রিপের মাধ্যমে অবশেষে যেনো সেই স্বপ্নটাই সত্যি হলো । 
আজকে যখন লিখতে বসেছি তখন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এসে ঠেকেছে ২৫এপ্রিল ২০২১ এ। এখনো মনে হয় আরে এইতো সেদিনের কথা... কিন্তু মাঝখানে দিয়ে প্রায় তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে । মেঘালয় ট্রিপের মাস পাঁচেক আগে গিয়েছিলাম সিমলা-মানালিতে আর বছরখানেক পরে গিয়েছিলাম কাশ্মীর-লাদাখে । ঘুরে এসে দুইটা ট্রিপ নিয়েই আলাদা করে দুইটা সিরিজও লিখেছি । কিন্তু যেকোন কারণেই হোক ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও মেঘালয় নিয়ে আর লেখা হয়ে ওঠেনি । কিন্তু সেই ইচ্ছেটাও আর কোনদিন পিছু ছাড়েনি । অবশেষে আজকে বাধ্য হয়ে নাছোড়বান্দা ইচ্ছেগুলোর পূর্ণতার স্বার্থে লিখতে বসে গেলাম । 

মেঘালয় সফর শেষে প্রথমেই আমার যেটা মনে হয়েছে সেটা হলো হানিমুনের জন্য অল্প আয়ের মানুষের জন্য বেস্ট অব দ্যা বেস্ট অপশন হলো মেঘালয় । যে মেয়েটা কোনদিন কোথাও ঘুরতে যাবার সুযোগ পায়নি, আজন্ম "বিয়ের পরে জামাই এর সাথে ঘুরিস" টাইপ ডায়ালগ শুনে বড় হয়েছে আর অসংখ্য সংশয় নিয়ে মনে মনে স্বপ্ন দেখেছে তার প্রিয়তম শওহরের সাথে একদিন সে অনেক দূরে বেড়াতে যাবে... হাতে হাত রেখে সমুদ্র,পাহাড়, ঝরণা দেখবে । এমন একটা মেয়েকে নিয়ে যুগল জীবন শুরুর প্রারম্ভে মেঘালয়ের মতো একটা জায়গায় বেড়াতে গেলে দেখবেন এই মেয়ে অহেতুক আপনার প্রেমে একদম পাগল হয়ে গেছে । এমন অসম্ভব মধুর কিছু স্মৃতি সঞ্চয় করতে পারবেন যেখানে থেকে বাকিটা জীবন রসদ সংগ্রহ করে কাটিয়ে দিতে পারবেন । ব্যক্তিগতভাবে আমার সেখানে কাটানো ৬ টা দিন যেনো পুরো জীবনের জন্য সৌন্দর্যের একটা রিজার্ভার হিসেবে রয়ে গেছে । যখনই মন খারাপ থাকে, চোখ বন্ধ করে মেঘালয়ের ৬ টা দিনের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকি । কেমন একটা সূক্ষ আবেশে মন ভালো হয়ে যায় । ওখানে ঘুরতে যাওয়ার আগে যে পরিমাণ মোহ কাজ করেছে, ঘুরে এসে মনে হচ্ছে মোহটা যেনো নিজের ভেতরে স্থায়ী বাসা বেঁধে নিয়েছে ।


আমাদের পরিচয় এবং টাইমিংঃ

গল্পের শুরুতে আমাদের তিন বন্ধুর পরিচয় দেই । আমি ফাহিম; বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র । বন্ধু সুফল আমার ক্লাসমেট । আর বাল্যবন্ধু কাওসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্সিয়ান লিটারেচার এন্ড ল্যাংগুয়েজ বিভাগের ছাত্র ।

আমরা তিনজন 

বরাবরের মতো এবারেও আমার এটা ছিলো একটা বাজেট ট্রিপ । সুতরাং শুরু থেকে শেষ অবধি বেশ হিসেবি আচরণের মধ্য দিয়েই কাটাতে হয়েছে আমাদের । মেঘালয় ট্রিপে বাজেট মেইনটেইন করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মিনিমাম চার থেকে পাঁচজন পার্টনার ম্যানেজ করা । কারণ এই ট্রিপে ট্যাক্সি ভাড়াই যায় বেশি । এই খরচ টা কমাতে পারলে গোটা ট্রিপের খরচই অনেক কমে যায় । আমি অনেক চেষ্টা করেও আর পার্টনার ম্যানেজ করতে পারিনি সত্যি বলতে । এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো ডেট টা । আমরা বের হয়েছিলাম ১৪ আগস্ট । যেখানে ২২ আগস্ট ছিলো পবিত্র ঈদ-উল-আযহা । তাই লোকজনের রেসপন্স কম পেয়েছি । 
কম বাজেটে যারা মেঘালয় ঘুরতে চান, আশা করি এই ব্লগটি তাদের অনেক উপকারে আসবে । যে কথাগুলো কেউ বলেনা, এমন কিছু কথা বলার ইচ্ছেটাই হলো আমার ব্লগের স্পেশালিটি । হোপফুলি আপনার প্ল্যানিং এর জন্য ব্লগটা অনেক হেল্পফুল হবে ।  

মেঘালয় সফরের জন্য টাইমিং টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু । আসলে টাইমিং নিয়ে হেডেক না থাকলে অনেক আগেই মেঘালয় ঘুরে আসতে পারতাম । যেহেতু মেঘালয় হলো ঝর্ণার রাজ্য, সুতরাং যেতে হবে বর্ষায় । যত পূর্ণ যৌবনা ঝর্ণা দেখতে চান, ততোই পার্ফেক্ট হতে হবে আপনার টাইমিং । ১৫জুন থেকে ১৫ জুলাই হচ্ছে আষাঢ় আর ১৬ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট হলো শ্রাবণ মাস । সুতরাং ১৫ জুন থেকে ১৫ আগস্ট হচ্ছে বর্ষাকালের ব্যাপ্তি । আপনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এই সময়ে যাবার জন্য । এই সময়ে না গেলে কি হবে জানেন ? দেশে ফিরে এসে গল্প করবেন ধুরু পিকচারে দেখলাম একরকম, বাস্তবে দেখলাম আরেক রকম । টাইমিং নিয়ে আমার এতো হেডেক ছিলো, তবুও কি পার্ফেক্ট হতে পেরেছিলাম আমরা ? ১৪ আগস্ট ২০১৮ খ্রিস্টাব্দকে বাংলায় কনভার্ট করলে দাঁড়ায় ৩০শ্রাবণ ১৪২৫ । এই সময়টাও সুন্দর । কিন্তু আমার সামান্য আফসোস রয়ে গেছে । কারণ আমার সবচেয়ে বেশি ফ্যাসিনেশন ছিলো চেরাপুঞ্জির ডান্থলেন ওয়াটারফল নিয়ে । ইউটিউবে ভিডিও দেখে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো । কি দুর্দান্ত পানির স্রোত ! অথচ সামনাসামনি গিয়ে দেখি কেমন আধমরা ঝর্ণা । সেসব গল্পে গল্পে সামনে চলে এলে বলবো । আসলে কপালও লাগে সত্যি বলতে । হয়তো আপনি গেলেন একদম পূর্ণ শ্রাবণে । কিন্তু যেদিন গেলেন তখন ভারী বর্ষণ হলো না, ব্যস ঝর্ণাগুলোও আধমরা হয়ে গেলো ! তখন আর কি করার থাকে । যাহোক আপনার যতোটা সাধ্য আপনি করবেন, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা ।  

তাহলে চলুন কয়েকটি পর্বের মাধ্যমে জানা যাক মেঘালয় ট্রিপের আদ্যোপান্ত... 

    👉মেঘালয় সফরনামাঃ প্রথম পর্ব (ডাউকি)
      👉মেঘালয় সফরনামাঃ দ্বিতীয় পর্ব (ডাউকি)
        👉মেঘালয় সফরনামাঃ তৃতীয় পর্ব (চেরাপুঞ্জি)
          👉মেঘালয় সফরনামাঃ চতুর্থ পর্ব (চেরাপুঞ্জি)
            👉মেঘালয় সফরনামাঃ পঞ্চম পর্ব (চেরাপুঞ্জি এবং শিলং)
              👉মেঘালয় সফরনামাঃ ষষ্ঠ পর্ব (ঘরে ফেরা)










              মন্তব্যসমূহ

              এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

              কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

              ১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

              একাদশ পর্বঃ ১২,৮২৭ টাকায় ১২ দিনে ঢাকা থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ (বিশেষ পর্ব)