 |
ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ
|
চেরাপুঞ্জি(Cherrapunji):
চেরাপুঞ্জির আসল নাম হলো ''Sohra". বৃটিশরা এই শব্দটাকে উচ্চারণ করতো "Cherra". আর এভাবেই ধীরে ধীরে সোহরা হয়ে গেলো চেরাপুঞ্জি । চেরাপুঞ্জি শব্দের অর্থ হলো "ল্যাণ্ড অব অরেঞ্জ" । তবে চেরাপুঞ্জি নামটাকে আবার পরিবর্তিত করে সোহরা করা হয়েছে । আপনি ওখানে বেড়াতে গেলে ম্যাক্সিমাম জায়গাতেই দেখবেন লেখা রয়েছে সোহরা । যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এটা চেরাপুঞ্জি নামেই সমাধিক পরিচিত ।
অদ্যবধি চেরাপুঞ্জি ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে আর্দ্রতম স্থান । বর্তমানে এই তকমাটা দখল করে নিয়েছে মেঘালয়ের অন্তর্গত Mawsynram নামের একটা স্থান । তবুও মাসিক বা বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণের দিকে গোটা পৃথিবীতে চেরাপুঞ্জি এখনো সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে । বাট এজ এ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, এতদসত্ত্বেও এখানে মানুষের অন্যতম প্রধান কষ্টের একটা বিষয় হলো খাবার পানি সংগ্রহ করা । অনেক সময় একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাদের খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয় ।
চেরাপুঞ্জিতে দেখার মতো যতোগুলো স্থান রয়েছে তার সবগুলোকে গুগল ম্যাপে বসিয়ে এডিট করে এখানে এটাচ করলাম । এতে করে জায়গাগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য করতে সুবিধা হবে আপনাদের। আমরা সবগুলোতে যাইনি । আর সবগুলো স্থান তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয় । আপনারা যারা আগামীতে যেতে ইচ্ছুক তাদের সুবিধার্থে এটা করা । এখানে থেকেই একদম পূর্ণাঙ্গ ধারণা আপনি পেয়ে যাবেন । চেরাপুঞ্জিতে দেখার জন্য সর্বসাকুল্যে ১৫ টা মেজর পয়েন্ট আমি নির্দেশ করলাম। এর বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই এখানে দেখার মতো । এখানে উল্লেখ্য স্থানগুলো হলোঃ
১। ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ (Double Decker Living Root Bridge),
২। রেইনবো ফলস (Rainbow Falls),
৩। ওই স্যাডং ফলস (Wei Sawdong Falls),
৪। ডান্থলেন ফলস (Dainthlen Falls),
৫। জানাইলার ফলস (Janailar Falls),
৬। ওয়াহ-কাবা ফলস (Wah-kaba Falls),
৭। আরওয়া কেভ (Arwah Cave),
৮। মাউকডক ভ্যালী ভিউ পয়েন্ট (Mawkdok Dympep Valley View Point),
৯। নোহকালিকাই ফলস (Nohkalikai Falls)
১০। সেভেন সিস্টারস ফলস (Seven Sisters Falls),
১১। ইকো পার্ক (Eco Park),
১২। মৌসিমাই কেভ (Mawsmai Cave),
১৩। থাংখারাং পার্ক (Thangkharang Park),
১৪। মটরপ (Khoh Ramhah / Motrop / Giant Conical Rock),
১৬। কিনরেম ফলস (Kynrem Falls).
 |
গুগল ম্যাপে নির্দেশিত চেরাপুঞ্জির সকল দর্শনীয় স্থান |
উল্লেখ্য স্থানগুলোর মধ্যে রেইনবো ফলস, ওই স্যাডং ফলস, জানাইলার ফলস, কিনরেম ফলস এবং আরওয়া কেভ আমাদের দেখা হয়নি । না দেখতে পারার পেছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি তথ্যের অপ্রতুলতাই মেজর রিজন ছিলো । আর এমনিতেও ট্রাভেলিং এর জন্য প্রয়োজনীয় সময়, অর্থ বা তথ্য... যেকোন একটা পয়েন্টে আপনার ঘাটতি থাকবেই । সুতরাং আপনি সব দেখতে পারবেন না, স্বাভাবিক বিষয় । অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘুরে আসার পরে জানতে পারবেন আশেপাশে আরো অনেক কিছু ছিলো দেখার মতো যা আপনারা মিস করে গেছেন । আজীবনই এটা হবে । গোটা পৃথিবী ঘোরা শেষ হলেও দেখবেন কিছু স্থান বের হবে যার পাশে দিয়ে আপনি ঘুরে এসেছেন কিন্তু সেটা আর দেখা হয়নি আপনার ।
সুতরাং আপনি একটা জায়গায় গিয়ে মেজর কিছু স্পট দেখলেন, সেখানকার মানুষের সাথে মিশলেন, কিছু ট্রেডিশনাল খাবার খেলেন, সেখানকার হাওয়াটা গায়ে মাখালেন... দ্যাটস ইনাপ । আফসোস নয়, উচ্ছ্বলতা নিয়ে ঘরে ফিরবেন ।
যাহোক, ওই কয়টা ঝর্ণার মধ্যে রেইনবো ফলস নিয়ে অনেক পজিটিভ ফিডব্যাক পেয়েছি । আর ওই স্যাডংটা ইউটিউবে দেখে ভালো লেগেছে । আপনারা সবগুলোই দেখতে পারেন । ভালোই লাগবে আশা করি । বাট ফ্যাক্ট হলো, কত ঝর্ণা দেখবেন আর বলেন ! ঠিক কতগুলো ঝর্ণা দেখলে ভালোলাগাটা প্রথম দিন দেখা ঝর্ণার মতো থাকে ? সুতরাং পারলে ইচ্ছে করেই কয়েকটা স্কিপ করবেন । আর আপনার সময়ের স্বল্পতা থাকলে তো আপনি স্কিপ করতে বাধ্য । আমার অভিজ্ঞতা বলে উমক্রেম, বোরহিল বা ক্রাংসুরির মধ্যে যেকোন একটি ঝর্ণা যে পরিমাণ ডোপামিন ক্ষরণের দায়ভার নেবে, বাকি সবগুলো মিলিয়েও সেটা সম্ভব না ।
ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ(Double Decker Living Root Bridge):(১৭/০৮/১৮)
লিভিং রুট ব্রীজ আসলে জিনিস টা কি ! নামটা খেয়াল করলেই কিছুটা বুঝতে পারবেন । "লিভিং রুট" অর্থাৎ জীবন্ত শিকড় । মানে জীবন্ত শিকড়ের তৈরি একটা ব্রীজকে বলা হচ্ছে লিভিং রুট ব্রীজ । এমনিতে এটাকে ন্যাচারাল বলা হলেও এটা আসলেও পুরোটাই প্রাকৃতিক নয় । সুন্দর শেপে এনে একে ব্রীজে রুপ দিতে মানুষজনকে অনেক খাটাখাটি করতে হয়, সেই সাথে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক বছর । এই জাতীয় ব্রীজ ভারতের শুধুমাত্র মেঘালয়েই বেশি দেখা যায় । এছাড়া অল্প কিছু রয়েছে নাগাল্যাণ্ডে এবং ইন্দোনেশিয়াতে । এক প্রকার রাবারের গাছের শিকড় থেকে এই জাতীয় ব্রীজগুলো তৈরি করা হয় । মেঘালয় ট্রিপে মাওলিনং এর সিঙ্গেল ডেকার আর চেরাপুঞ্জির ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ দুইটাই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় । আমরা তো সিঙ্গেল ডেকার টা দেখিনি । ডাবল ডেকার দেখতে গিয়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে সেটা হলো জীবনে প্রথম দেখা ব্যতিক্রমী একটা অনুষঙ্গ হিসেবে এটা ভালো লাগবে । কিন্তু এই ব্রীজের মূল সৌন্দর্য হলো তিরনা থেকে এই ব্রীজে আগমনের রুট টা । আপনারা হয়তো অলরেডি অবগত আছেন যে এই ব্রীজে যেতে হলে ৩৫০০ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয় । সে এক অন্যরকম থ্রিল, ব্যতিক্রমী ট্রেকিং আর অসম্ভব সৌন্দর্যে ভরা একটা রুট এটি ।
যাহোক পরদিন একদম ভোরে ঘুম থেকে উঠে ৫ জন মিলে রওনা হলাম ডাবল ডেকারের উদ্দেশ্যে । আমরা যখন ট্রেকিং শুরু করি তখন প্রায় সকাল ৬ টা বাজে । সারারাতের ক্যাটস এণ্ড ডগস এখন আবার ডিজলিং এ রুপান্তরিত হয়েছে । ট্রেকিং এর শুরুতে আজকে আর কেউ বাঁধা দিলো না । ট্রেকিং শুরুর কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম কেনো ওরা বিকাল ৫টার পরে এই রুটে কাউকে এলাউ করে না । আসলে এতো ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আর পাহাড়ের বাঁক দিয়ে এই রুট চলে গেছে যে খোলা জায়গার চেয়ে আলো অনেক কম থাকে এই রুটের অনেক পয়েন্টে । অর্থাৎ বিকেলে বের হলে একটু পরেই দেখতাম চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে । পথ হারিয়ে ফেলার ভয় ছিলো প্রবল ।
এমনিতে এই রুটে কোন গাইড লাগে না । রুট ট্র্যাক করা একদম ইজি । কিন্তু তবুও অনেকেই দেখি গাইড নেয় । শুধুমাত্র দুই-তিনটা পয়েন্টে গিয়ে সামান্য কনফিউজড হতে পারেন । সেক্ষেত্রে পাশেই দেখবেন সাইনবোর্ডে ডিরেকশন দেয়া আছে নাহলে স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে । খুবই সিম্পল । আমাদের কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি । পথই আমাদের গন্তব্যে নিয়ে গিয়েছে ।
ট্রেকিং শুরুর একটু পরেই দেখি সুন্দরের সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি । পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো, পাখিদের ডাকাডাকি, টিপটিপ বৃষ্টি আর সবুজের মহাসমারোহ... সবমিলিয়ে ট্রেকিং এর পুরোটা সময় জুড়েই একটা দারুণ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন ছিলাম । আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রেইনকোট বা ছাতা সাথে নিয়েছিলেন। আমি ডিএসএলআর হোটেলে রেখে স্রেফ মাথায় একটা পলিথিন বেঁধে ট্রেকিং শুরু করেছিলাম । আলগা পেইন নিয়ে এতো সুন্দর ট্রিপটা নষ্ট করার কোন ইচ্ছেই ছিলো না ।
অনেক পিক তুলেছিলাম যাত্রাপথে । মাঝেমাঝে শুনি অনেকেই নাকি এডিট করে পিক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সুন্দর করে উপস্থাপন করে সোস্যাল সাইটে । আমার কাছে কেনো যেনো কখনোই মনে হয়না পিক কখনো বাস্তবের চেয়ে সুন্দর হতে পারে । এই যে পাখির ডাক, ঝর্ণার শব্দ, পথচলার ছন্দ, বৃষ্টির শব্দ, সোঁদা মাটির গন্ধ... এই জিনিসগুলো কি পিক দেখে অনুভব করা যায় ! এজন্য প্রকৃতির ঠিক মাঝে দাঁড়াতে হয় । শরীরের প্রতিটি অঙ্গের আলাদা আলাদা অনুভব ক্ষমতা রয়েছে । পিক দেখার মাধ্যমে শুধু চোখের সেন্সেশনটাই নিতে পারবেন, কিন্তু বাকিগুলো স্রেফ অধরাই রয়ে যাবে । পিক যে বাস্তবের চেয়ে সুন্দর হতে পারেনা... এটা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম লাদাখ বেড়াতে গিয়ে ।বেড়াতে যাওয়ার আগে লাদাখের অনেক পিক দেখেছি । কিন্তু কেনো যেনো লাদাখের এই বর্ণহীন রুক্ষ চিত্র আমাকে কখনোই টানেনি । আমি লাদাখে বেড়াতে গিয়েছিলাম স্রেফ লাদাখের প্রতি মানুষের ক্রেজের কারণ অন্বেষণের জন্য । গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। গাছপালা শূণ্য রুক্ষ একটা জায়গা যে এতোটা ভালোলাগায় পরিপূর্ণ ছিলো যা বলে বোঝাতে পারবো না । মানে এই বিষয়টা ওখানে না গিয়ে আসলে বোঝানো সম্ভব না । প্যাংগং লেকে গিয়ে এক রাত ছিলাম । আমার জীবনের সেরা রাত ছিলো সেটি । পৃথিবীর কোন ক্যামেরার সাধ্য নেই যা লাদাখকে লাদাখের মতো করে, প্যাংগং কে প্যাংগং এর মতো করে ছবি তুলতে পারে । লাদাখ থেকে ঘুরে আসার পরে কয়েকদিন ট্রমাটাইজড হয়ে ছিলাম আমি । কি দেখলাম এটা !
যাহোক, প্রায় দুই ঘণ্টা পরে ৩৫০০ সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা চলে এলাম ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজে । পথিমধ্যে আরো একটা লিভিং রুট ব্রীজ এবং দুইটা ঝুলন্ত সেতু পড়েছিলো । ডাবল ডেকার ব্রীজটা যেখানে পড়েছে সেই গ্রামটার নাম হলো নংরিয়েত । এখানে পর্যটকদের রাত্রি যাপনের অনেক সুব্যবস্থা রয়েছে । আপনারা কেউ চাইলে আগের দিনে বিকেলে এসে এখানে রাত্রিযাপন করতে পারেন । আইডিয়াটা দারুণ হতে পারে সত্যি বলতে । ডাবল ডেকার ব্রীজের পাশেই রয়েছে ন্যাচারাল সুইমিং পুল । এখানে আমরা গোসল করেছিলাম । ব্যাপক ছিলো সময়টা । গোসল যেনো শেষ করতেই ইচ্ছে করছিলো না । সময় দৌঁড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো । প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো ছিলাম এখানে । ফিরে যেতে হবে আবার । কারণ তনু ভাই আর হাসান ভাই চলে যাবেন আজকে । তাই কিছুক্ষণ লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করে ব্যাক ওয়েতে হাঁটা শুরু করলাম ।
 |
ডাবল ডেকার রুট ব্রীজ ট্রেকিং |
 |
তনু ভাই এর ক্লিকে আমরা চারজন |
 |
পাহাড়ের খাঁজে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো |
 |
এই পাথরের স্তুপের পাশে দিয়েই ট্রেকিং করতে হয় |
 |
সিঙ্গেল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ(১ম ঝুলন্ত ব্রীজ) |
 |
ডাবল ডেকার রুট ব্রীজ ট্রেকিং
|
 |
দ্বিতীয় ঝুলন্ত ব্রীজ |
 |
তৃতীয় ঝুলন্ত ব্রীজ |
 |
এমন অসংখ্য সুন্দর দৃশ্য রয়েছে এই রুটে |
 |
ন্যাচারাল সুইমিং পুল
|
 |
ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ |
বলে রাখি, এখানে ঘোরার জন্য আমাদের জনপ্রতি ২৪ রুপী করে ফি দিতে হয়েছে । যদিও গুগলে দেখলাম এন্ট্রি ফি আসলে ১০ রুপী, ক্যামেরার জন্য অতিরিক্ত ২০ রুপী দিতে হয় । আমাদের সাথে কোন ক্যামেরা ছিলো না তবুও কেনো জনপ্রতি ২৪ রুপী গেলো, বুঝলাম না । এখানে থেকে আরো ঘণ্টাখানেক(ট্রেকিং) দূরে ছিলো রেইনবো ফলস । আমরা তখন অবধি এটা জানতাম বলে আর সেদিকে যাওয়া হয়নি । কিন্তু পরে আফসোস হয়েছে খুব । অনেক সুন্দর ঝর্ণা নাকি শুনি । নেক্সট টাইম মেঘালয় গেলে অবশ্যই রেইনবো ফলস দেখতে যাবো ।
ফিরতে ফিরতে আবার দুই ঘণ্টা লেগে গেলো । যাত্রাপথে অনেকের সাথে দেখা হলো, গল্প হলো । আমাদের সাথে যারা ব্যাক ওয়েতে হাঁটছিলো তারা সবাই রাতে নংরিয়েত গ্রামে ছিলো । সকালে সব দেখে এরপরে ব্যাক করছে ধীরে ধীরে । আমরা সকালে এসে দেখে এরপরে তাদের সাথে ব্যাক করছি শুনে কিছুটা অবাকই হচ্ছিলো সবাই । কারণ এই রাস্তা দুই ঘণ্টায় শেষ করাটা একটু কষ্টসাধ্য । আমাদের তাড়া ছিলো বলে পেরেছিলাম । একটা বিষয় এড করি । ট্রেকিং এর শুরুতে ভেবেছিলাম এই সিঁড়িগুলো হয়তোবা যাওয়ার সময় শুধু উপর দিকে উঠবে, আর ফেরার সময় শুধু নামবে । কিন্তু গিয়ে দেখি এটা আসলে সেরকম কিছু না। কিছু জায়গায় উপরের দিকে উঠেছে আবার কিছু জায়গায় নেমেছে । অনবরত আপস&ডাউনের মধ্যেই ছিলো এই রুটটা । ৩৫০০ সিঁড়ি যদি শুধু আপহিলের দিকে হতো তাহলে উঠতে গেলে ফেটে যেতো একদম । ৩৫০০ সিঁড়ি মানে প্রায় ১৩০ তলা বিল্ডিং এর সমান ।
যাহোক ফিরে এসে যখন তিরনাতে আমাদের হোমস্টে তে পৌঁছাই তখন সকাল এগারোটার মতো বাজে । যাত্রাপথেই কিছু পাহাড়ি ফলমূল কিনে খেয়েছিলাম, এটাই আমাদের ব্রেকফাস্ট ছিলো । অনেক কম দামেই পেয়েছিলাম। সেখানে থেকে ফ্রেশ হয়ে চেক আউট করে চলে গেলাম চেরাপুঞ্জিতে । এখানে আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া গেলো জনপ্রতি ১০০ রুপী । বেলা বারোটার মতো বাজে । গতদিনের সেই হোটেলে গিয়ে ভরপেট খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম । খেতে খেতেই বেলা ১টা বেজে গেলো । এরপরে সেখানে থেকে পাঁচজন মিলে চলে গেলাম শিলং । এখানে জনপ্রতি ট্যাক্সি ভাড়া গেলো ১০০ রুপী । একটা জিনিস বলে নেই । ডাউকি-চেরাপুঞ্জি-শিলং এই তিন স্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশি হলেও পথিমধ্যে কোথাও অপেক্ষা করতে হয়না বলে এবং সরাসরি আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ভাড়া অনেক কম । কিন্তু এই তিন জায়গা বাদে অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে দূরত্ব কম হলেও ভাড়া বেশি লাগে । কারণ টা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন ।
তনু ভাই আর হাসান ভাই সরাসরি চেরাপুঞ্জি থেকে ডাউকি চলে না গিয়ে আমাদের সাথে শিলং যাবার পেছনের কারণ হলো তাদের রুপী শর্ট পড়েছে । কিছু কেনাকাটা করা আর ডলার ভাঙ্গানোর জন্য তাদের শিলং যাওয়া । প্রায় দুইটার দিকে শিলং পৌঁছে তাদের বিদায় দিয়ে আমরা তিন বন্ধু আলাদা হয়ে গেলাম । এই ট্রিপের পরবর্তী অংশটুকু আমরা তিন জন মিলেই সম্পূর্ণ করেছি ।
আমাদের আগামীকালের প্ল্যান হলো শিলং ট্যুরিজম কর্পোরেশনের একটা প্যাকেজ নিয়ে চেরাপুঞ্জি সফর করা । খুঁজে খুঁজে তাদের অফিস বের করে বুক দিলাম । জনপ্রতি ৩৫০ রুপী লাগলো । প্যাকেজ ট্রিপ কেমন হয় সেটা এক্সপেরিয়েন্স করার জন্য আমরা শুধুমাত্র একটা দিনের জন্যই বুক দিলাম ।
ডন বস্কো মিউজিয়াম(Don Bosco Museum):
আজকে আর বিশেষ কোন প্ল্যান নেই আমাদের তিনজনের । সিদ্ধান্ত নিলাম যা সময় অবশিষ্ট আছে তাতে ডন বস্কো মিউজিয়ামটা ঘুরে আসা যাবে । আপডাউন ৪০০ রুপীতে একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করে তিনজন মিলে চলে গেলাম মিউজিয়ামে । এখানে ভারতীয়দের এন্ট্রি ফি ১০০ রুপী, বিদেশীদের ২০০ রুপী আর বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ১৫০ রুপী । বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য যে ১৫০ রুপী লাগে এটা আমরা জানতাম না । তাই জনপ্রতি ২০০ রুপী দিয়েই ঢুকতে হলো । ঢুকে পুরো হতাশ হয়ে গেলাম । এই ঘোড়ার ডিম দেখার জন্য শিলং থেকে ট্যাক্সি ভাড়া+এন্ট্রি ফি মিলিয়ে জনপ্রতি ৩৩৩ রুপী নষ্ট হলো শুধু । এমনিতেই শিলং ডে ট্রিপ নিয়ে আমার এতোটা আগ্রহ ছিলো না । কারণ আমি জানতাম যে সারা মেঘালয় মিলিয়ে যেসব দেখেছি সেই হিসেবে সিটি ট্রিপ শুধু সময় আর টাকা নষ্ট ব্যতীত কিছু নয় । মাঝখানে দিয়ে শুরুতেই এমন একটা স্পটে গেলাম... যেখানে গিয়ে বাকি সিটি ট্রিপের আগ্রহটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেলো ।
 |
ডন বস্কো মিউজিয়ামের সামনে |
 |
ডন বস্কো মিউজিয়ামের সামনে আমরা তিনজন |
ভেতরে ক্যামেরা এলাউড না । তাই মিউজিয়ামের ভেতরে কোন ছবি তুলতে পারিনি । মিউজিয়ামের বিষয়বস্তু মূলত খিস্টধর্মের আবর্তন তথা ডন বস্কোর ধর্মীয় চেতনাকে তুলে ধরা । মিউজিয়ামের সংগ্রহশালা বলতে অধিকাংশই বিভিন্ন মানুষজনের হাতে আর্ট করা খ্রিস্টধর্ম কেন্দ্রিক চিত্রকলা আর কিছু ভাস্কর্য । মানে এটাকে মিউজিয়াম না বলে আর্ট গ্যালারি বললে ভালো হতো । তাহলে এক্সপেক্টেশনও সেই লেভেলে থাকতো আর দেখেও ভালো লাগতো । তবে একটা জিনিস সত্য যে মিউজিয়ামের ছাদ থেকে শিলং শহরটা দেখতে দারুণ লাগছিলো । মিউজিয়াম ঘুরে যখন ছাদে গেলাম, দেখি ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে । মেঘালয়ের প্রেমে আমি এজন্যই এতোটা পাগল । কথা নাই, বার্তা নেই হুটহাট বৃষ্টি নামে...কখনো টিপটিপ তো কখনো ঝমঝম... প্রকৃতির এই খেলাটাই সবচেয়ে চমৎকার লাগে আমার কাছে । একটা রবীন্দ্রসংগীত মনে পড়ে যায় -
"আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেনো যে মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন বেগে
উদ্ভ্রান্ত মেঘে...
মন চায়... মন চায়...
ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
মেঘমাল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরণার গান ।
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা
মন চায়... মন চায়...
হৃদয় জড়াতে কারো চির-ঋণে ! "
কেউ নেই, তবুও বিল্ট ইন সফটওয়ারের কারণে ভেতরে একটা প্রেমিক স্বত্বা জেগে ওঠে । ইচ্ছে করে কেউ একজনের হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজি । অথবা টিনের চালের নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ধোঁয়া ওঠা গরম কফি খাই তার সাথে ! সুযোগটা হলো না অদ্যবধি । ইচ্ছেগুলো জমিয়ে রাখলাম । "মন চায়... মন চায়... / হৃদয় জড়াতে কারো চির-ঋণে !" দেখা যাক ঋণের দেনায় জর্জরিত হবার সৌভাগ্য কোনদিন মেলে কিনা ।
ঘণ্টাখানেক মিউজিয়াম ঘুরে তিন বন্ধু মিলে যখন শিলং ব্যাক করলাম তখন ঘড়িতে ছয়টার মতো বাজে । এখন আমাদের মূল কাজ হলো হোটেল খোঁজা । এবার বিশাল ঝামেলায় পড়ে গেলাম । আমাদের মতো দরিদ্র ট্রাভেলারদের জন্য শিলং যেনো একদমই অনুদার । কম খরচে হোটেল খোঁজার যত রকম টেকনিক আছে সব এপ্লাই করা শেষ হলেও কোন হোটেল পাচ্ছিলাম না । বেশ কষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সত্যি বলতে । যাও বা দুই একটা কম খরচের হোটেল পেলাম সেখানে ফরেইনার এলাউ না । অনেক ঝামেলা করে পুলিশ বাজারের কাছে একটা হোটেল পেলাম । এই হোটেলে একটা রুম আসলে টেম্পোরারিলি এক্সটেনশন হিসেবে ছিলো ।
 |
আমাদের হোটেল রুম |
আমাদের বাজেট শুনে তারা এই রুমটা অফার করলো । রুমে তিনটা দ্বিতল বেড ছিলো । আসবাব আর বিশেষ কিছু ছিলো না । ভাড়া চাইলো জনপ্রতি ২৫০ রুপী । আমরা সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম । আমাদের যে বাজেট তাতে কাঁটা বাছাটা বোকামি । সেখানে এই রুমটা ভালোই ছিলো । ব্যস এটাই ছিলো আমাদের পরবর্তী তিন রাতের ঠিকানা ।
নোটঃ এই ট্রিপে গিয়ে হোটেল সিলেক্ট করা নিয়ে একটা জিনিস বুঝলাম । মেঘালয় সফর মানেই বিষয়টা এমন যে রাতে গিয়ে শিলং থাকা । এরপরে সেখানে থেকে সারাদিন শিলং বা চেরাপুঞ্জি ঘুরে বেড়ানো । যেখানে ম্যাক্সিমাম স্পটই চেরাপুঞ্জিতে সেখানে মানুষজন গিয়ে শিলং এ হোটেলে থাকে । ট্যুর শেষে বুঝলাম এই কাজটা ভুল করে সবাই । বাজেট ইস্যু থাকলে আপনারা অবশ্যই চেরাপুঞ্জিতে থাকবেন রাতে । এখানে কম বাজেটের অনেক হোমস্টে রয়েছে, আর থাকাও যায় একদম প্রকৃতির মাঝে । যেখানে শিলং থাকতে হয় শহুরে পরিবেশে আর রেন্টও বেশি । উপরন্তু ম্যাক্সিমাম ট্যুরিস্ট স্পটই চেরাপুঞ্জিতে । সুতরাং সবমিলিয়ে বাজেট ইস্যু না থাকলেও শিলং নাইট স্টে করাটা খুব একটা কাজের কাজ বলে মনে হয়নি আমার কাছে ।
আমি ভারতের বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরেছি । দিল্লি, কলকাতা, লাদাখ, কাশ্মীর, সিমলা, মানালি, বেঙ্গালোর, ভেলোর সহ আরো অনেক জায়গাতে ঘুরেছি । সব জায়গাতে হোটেল ভাড়া গেছে গড়ে ২৫০ রুপী । সব মিলিয়ে আমার কনফিডেন্স টা এমন জায়গায় চলে গেছে যে ২০০-৩০০রুপীর মাঝে ইন্ডিয়াতে হোটেল পাবো না, এটা হতেই পারেনা । এই কনফিডেন্সের জন্যই মূলত শিলং গিয়ে এমন ঝামেলায় পড়েছিলাম । যদিও শেষ অবধি আমার কনফিডেন্সেরই জয় হয়েছে । অনেক কষ্ট হলেও আমরা তো এই রেঞ্জের বাজেটে হোটেল পেয়েছিলাম সেবার । তবে খুঁজতে গিয়ে এমন প্যারা গেছে যে মনে হয়েছে নেক্সট টাইম নাও পেতে পারি । শিলং হোটেলে থাকতে হলে তিনজনের মিনিমাম বাজেট হতে হবে ১৫০০ রুপী । তাহলে হোটেল পেতে সমস্যা হবে না । যাহোক, আমরা আমাদের হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে এরপরে বাজারে গেলাম । খাওয়া-দাওয়া করে ফের হোটেলে ফিরে এসে ঘুম দিলাম ।
আজকের খরচঃ (১৭/০৮/১৮)
১। ডাবল ডেকার ব্রীজ এন্ট্রি ফি = ২৪/-
২। ট্যাক্সি ভাড়া = ২০০/-
৩। ডন বস্কো = ৩৩৩/-
৪। হোটেল ভাড়া = ২৫০/-
৫। সারাদিনের খাবার খরচ = ২২০/-
...........................................................
মোটঃ ১০২৭ রুপী (জনপ্রতি)
ভাই শিলং এর অই হোটেল টার নামি কি বলা যাবে?
উত্তরমুছুনহোটেল ব্লু পাইন
মুছুন