মেঘালয় সফরনামাঃ প্রথম পর্ব (ডাউকি)

 

উমগট রিভার সাসপেনশান ব্রীজ

ট্রাভেলিং টু মেঘালয়ঃ(১৪/০৮/১৮)

আমাদের এই ট্যুরের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী রাত সাড়ে নয়টার উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে । ট্রেনের টিকিট তিনদিন আগেই কেটে রাখা হয়েছিলো । শোভন চেয়ারের মূল্য পড়েছিলো জনপ্রতি ৩২০ টাকা । ট্রেনে চেপেই তিনজন আড্ডা দেয়া শুরু করে দিলাম । ঘুম-আড্ডা মিলিয়েই ট্রেন জার্নি শেষ হয়ে গেলো । ট্রেন যখন সিলেটে পৌঁছায় তখন ভোর সোয়া পাঁচটা বাজে । 
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন 

এই ট্রিপের প্রথম ভুলটা করলাম সিলেট স্টেশনে পৌঁছেই । ভাবলাম মাত্র ৫ টা বাজে, এতো তাড়াতাড়ি তামাবিল গিয়ে কি করবো । বর্ডার খুলবে ৯ টার সময় । সুতরাং অনেক সময় আছে ভেবে তিন বন্ধু স্টেশনের বেঞ্চে শুয়েই ল্যাটালাম কিছুক্ষণ । এরপরে ধীরে সুস্থে স্টেশন থেকে বের হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । এরপরে জাফলং এর বাসে চেপে বসলাম । বাসভাড়া গেলো জনপ্রতি ৬০ টাকা । সিলেট - জাফলং রুটের ভেতরেই তামাবিল পয়েন্ট এর অবস্থান । বাস জার্নিতেই আমাদের আড়াই ঘণ্টার বেশি চলে গেলো । 

বর্ডার ক্রসঃ(১৫/০৮/১৮)

বাস যখন তামাবিল পৌঁছায় তখন ঘড়িতে বাজে সকাল ৯ টা ৪৫ । টাইম দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো । সিলেটে নেমেই কেনো দ্রুতপদে অগ্রসর হলাম না, এই মর্মে বেশ আফসোস হচ্ছিলো । বর্ডার ৯টায় ওপেন হলেও সিরিয়াল দেয়া লাগে অনেক আগে থেকেই । সুতরাং সিরিয়ালে গাণিতিক ভাবে পিছিয়ে পড়লে বর্ডার ক্রস করতে জ্যামিতিক হারে দেরি হওয়াটা নিয়মের কথা । আর বেশি দেরি হলে আজকে সারাদিন ডাউকি ট্রিপের যে প্ল্যানটা আমরা করেছি, তা এলোমেলো হয়ে যাবে । আপনারা যখন যাবেন, যত সকালে সম্ভব চলে যাবেন । এতে করে দ্রুত বর্ডার ক্রস করতে পারবেন । 

আসলে যতগুলো সমস্যা এবং সুবিধা বললাম, সবই আমাদের আগে থেকেই জানাশোনাই ছিলো । স্রেফ বিষয়টা গুরুত্ব না দেয়ার কারণেই এই অনাকাঙ্খিত বিড়ম্বনায় পড়তে হলো । কি পাঠকগণ ! ৪৫ মিনিটের জন্য এতো কথা বলাকে কি প্রগলভতা বলে মনে হচ্ছে ? মোটেও তা ভাবার অবকাশ নেই । কারণ এই বিলম্বের জন্য আমাদের যে মূল্য পরিশোধ করতে হলো তার মূল্যমান ছিলো সিম্পলি গোটা দিনটাই । এক অনাকাঙ্খিত দৃশ্যকল্পের অংশ হয়ে গেলো আজকের দিনের বর্ডার ক্রসে আগ্রহী মানুষগুলো । 

অনুগ্রহ করে আজকের ডেটটা একটু খেয়াল করুন তো আবার । হুম ১৫ আগস্ট । ১৫ আগস্টের কি কি স্পেশালিটি বলেন তো ? আচ্ছা আমিই বলি । আজকে আমাদের জাতীয় শোক দিবস আর ভারতীয়দের স্বাধীনতা দিবস ।  আজকের এই ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস আমাদের জন্য একটা কষ্টকর অভিজ্ঞতার কারণ  হয়ে দাঁড়ালো । বর্ডার ক্রস করতে প্রায় পুরো দিনটাই চলে গেলো । আজকের দিনে ডাউকিতে ঘোরাঘুরি নিয়ে যে প্ল্যানটা সাজিয়েছিলাম, তা শুরুতেই মারা পড়লো । 

যাহোক, তিন বন্ধু মিলে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম । এরকম একটা ভীড়ে ভরা ইমিগ্রেশন পয়েন্টে একটাও কম্পিউটার নেই । বিষয়টা খেয়াল করেই অবাক হয়ে গেলাম । সব কাজ ম্যানুয়ালি হাতে করে ওরা । ছোটবেলায় আব্বুর সাথে যখন কৃষি ব্যাংকে যেতাম, তখন দেখতাম কিভাবে একটা ব্যাংকও কম্পিউটার ছাড়া চলতে পারে । মানে কম্পিউটার ছাড়া যে একটা সময়ে মানুষ অনেক কিছুই করতো আজকের এই সময়ে এসে এটা ভাবলেও অবাক হতে হয় । যাহোক ম্যানুয়ালিই সব কাজ শেষ করলাম । ওখানে স্পিড মানি দিতে হলো জনপ্রতি ১০০ টাকা । আমি বেড়াতে গিয়ে সহজে পয়সা অপব্যয় করিনা, সেই মানুষকে যখন স্পিড মানি দিতে বাধ্য করা হয় সেটা নিতান্তই খারাপ লাগার বিষয়ই বৈকি । মানে ওখানে এই জিনিস টা এতো বেশি প্রতিষ্ঠিত আর ওরা এতো কনফিডেন্সের সাথে সেটা নেয় যে টাকা দেয়াটা যেনো একটা সরকারি নিয়ম ।  তবে আপনারা কয়েকজন মিলে দিলে কিছু কম দিতে পারবেন  । 

কি আর করার ! সবাই দেয়, আমাকেও দিতে হলো । আমার সাথে একটা ডিএসএলআর ছিলো । ওরা এন্ট্রিফরমে ক্যামেরার মডেল টা লিখে নিলো । কোন টাকা নিলো না এজন্য । যদিও বর্ডারে ক্যামেরা পাস করা নিয়ে হরহামেশাই গণ্ডগোলের কথা শুনতে পাই । আমি কখনো ফেস করিনি যদিও । আপনারা এই বিষয়ে একটু সতর্ক থাকবেন । ব্যক্তিগত সাজেশন হলো পারলে এই ঘোড়ার ডিম নিয়ে ঘুরতে যাওয়াই বাদ দিয়ে দিন । অহেতুক একটা ব্যক্তিগত প্যারা সাথে নিয়ে ঘোরা । আমি গত প্রায় তিন বছর যাবত ক্যামেরা নিয়ে ট্যুরে যাইনা । 

নো ম্যানস ল্যাণ্ডে

যাহোক, বাংলাদেশ অংশের ইমিগ্রেশন কাজ শেষ করতে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে গেলো । ঘড়িতে বাজে পৌনে বারোটার মতো । পা দিলাম নো ম্যানস ল্যাণ্ডে । এবার ভারত অংশের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পালা । বুঝলাম না সংশ্লিষ্টরা কি কাজ করে যে আমাদের প্রায় ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে । মানুষে গিজগিজ করছে, বসার জায়গা নেই, ফ্যান ঘোরেনা ঠিকমতো । সবমিলিয়ে একটা যাচ্ছেতাই পরিস্থিতি । মোটামুটি অর্ধশিক্ষিত, আনস্মার্ট, এলোমেলো বেশভূষার মামা ক্যাটাগরির মানুষগুলো সব এখানে দায়িত্বরত দেখলাম । ব্যাপারটা এমন যে আপনি কোন এক রোদ্রতপ্ত দুপুরে কোন একটা সরকারি ব্যাংকে গেছেন কাজ করতে । গিয়ে দেখেন বিশাল সিরিয়াল । অথচ সংশ্লিষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসার কম্পিউটারের কি-বোর্ড চাপছেন জুটোপিয়ার(অত্যন্ত ধীরগতিতে) মতো করে । কি বোর্ডের একটা একটা করে কি দেখেন আর চাপেন... মেজাজ টা কেমন খারাপ হবে ভাবুন তো ! আবার তারা এতোই ড্যামকেয়ার যে তাদের কিছু বলেও লাভ হয় না । 

আমাদের অবস্থাও কিছুটা এমনই হয়েছিলো । আগস্ট মাসের গরমে ক্যার ক্যার শব্দে ঘূর্ণনরত একটা ফ্যানের নীচে বসে সবাই শুধু ঘামছিলাম । খুব বাজে একটা এক্সপেরিয়েন্স ছিলো এটা । সবমিলিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা লেগে গেলো আমাদের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে । 

বলে রাখা ভালো কাওসারের একটা ইস্টার্ণ ব্যাংকের ডুয়াল কারেন্সি একুয়া কার্ড ছিলো । আমরা তিন বন্ধু মিলে জার্নির দুই-তিন দিন আগে ঢাকা থেকেই সেই কার্ডে টাকা জমা করেছিলাম । সবমিলিয়ে প্রায় ২৫,০০০ টাকার উপরে ছিলো ব্যালান্স । বেনাপোল বর্ডারে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট নিয়ে কখনো ঝামেলায় না পড়লেও ডাউকি বর্ডারে দেখলাম খুব ঝামেলা করে । আমাদের কাছে যে ডলার আছে তার প্রমাণ হিসেবে কাওসারের ফোনে টাকা জমার সেই এসএমএস দেখাতে হয়েছে আমাদের এবং স্পষ্ট কনফিডেন্সের সাথে বলতে হয়েছে যে এই টাকাটা আসলেই আমাদের তিনজনের । ওদের যদি মনে হতো এই টাকা আসলে একজনের, তাহলে বাকি দুইজনের সাথে ব্যাপক ঝামেলা করতো ।

আমরা ঘুরে আসার কিছুদিন পরে আমার ভার্সিটির কয়েকটা জুনিয়র ঘুরতে গিয়ে এই বিপদে পড়েছিলো। ওদের মধ্যে একজনের কাছে ডলার ছিলো না । আরেকজনের ডুয়াল কারেন্সি কার্ডে মোর দ্যান ইনাপ মানি ছিলো । কিন্তু সবাই পার্সোনালি ডলার শো করায় সেই ডলারহীন ছেলেটা পড়ে যায় বিপদে । পরে বহুত নাটক করে তবে রক্ষা পেয়েছে । আমি বললাম - তোরা যেকোন দুইজন মিলে ওকে নিয়ে গ্রুপ করে ডলার শো করলেই ঝামেলা মিটে যেতো । ওরা বললো আসলে ওরা বুঝতে পারেনি এটা নিয়ে এভাবে ঝামেলায় পড়তে হবে । সুতরাং আপনারাও এই ডলার এন্ডোর্স এর ঝামেলা টা মাথায় রাখবেন । 
 
ট্রাভেল ট্যাক্সের বিষয়টা এড করি ।  জার্নির কিছুদিন আগে আমি আর কাওসার মিলে সোনালি ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় আমাদের তিনজনের ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিয়ে গিয়েছিলাম । তামাবিল বর্ডারে আসলে ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়ার ব্যবস্থা নেই । এটা আরেক প্যারাদায়ক ইস্যু । এটা পে করার জন্য আপনার হাতে দুইটা অপশন রয়েছে । সিলেট গিয়ে ট্রাভেল ট্যাক্স দিতে হবে নাহলে ঢাকা থেকে দিয়ে যেতে হবে । এখন আপনি যদি সিলেট পৌঁছে দিতে চান এজন্য আপনাকে সকাল নয়টা অবধি ব্যাংক খোলার জন্য অপেক্ষা করতে হবে । এরপরে পেমেন্ট শেষ হতে হতে দশটা, তামাবিল পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাজবে ১ টা । মানে আপনার একটা দিনই মাটি । আর আপনি যদি ঢাকা থেকে দিয়ে যেতে চান তাহলে সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল বা অন্য কোন শাখায় অগ্রীম জমা দিয়ে যেতে হবে । উল্লেখ্য যে সোনালী ব্যাংকের সকল শাখায় কিন্তু ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়া যাবে না । সুতরাং যে শাখায় জমা দিতে চাচ্ছেন, তারা আদৌ সেটা এলাউ করে কিনা, আগে থেকেই বিষয়টা নিশ্চিত হয়ে যাবেন । যে কেউ যে কারো হয়ে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিতে পারবেন, সমস্যা নেই । আমার সাজেশন হলো ঢাকা থেকে ট্রাভেল ট্যাক্স দিয়ে যাওয়াই ভালো । 

খুব রিসেন্টলি অনলাইনে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । তবে সেটা শুধুমাত্র বেনাপোল, দর্শনা এবং ভোমরা স্থলবন্দরের জন্য প্রযোজ্য । খুব শীঘ্রই অন্যান্য পোর্টও এড হবে বলে জানানো হয়েছে । এজন্য আপনারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে বিকাশ, রকেট সহ যেকোন কার্ডের মাধ্যমে খুব সহজেই ট্রাভেল ট্যাক্স পে করতে পারবেন । তবে এজন্য আপনাকে গেটওয়েভেদে ৮-১৫ টাকা অতিরিক্ত পে করতে হবে । অন্যান্য পোর্ট... স্পেশালি ফুলবাড়ি, চেংড়াবান্ধা এবং ডাউকি পোর্ট এড করলে ট্রাভেলারদের জন্য সত্যিই অনেক খুশির খবর হবে এটা । কারণ যারা রেগুলার ভ্রমণ করে থাকেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন এই ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়াটা কি প্যারার কাজ । বেনাপোলে বর্ডারে গিয়ে ইন্সট্যান্ট দেয়া যায়, তবুও ঝামেলা । কারণ সময়ভেদে বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্স দেয়া লাগে। সেক্ষেত্রে অনলাইন পেমেন্ট অনেক ভোগান্তির অবসান করাবে বলে আমি আশাবাদী । 

গল্পে ফিরে যাই । বেলা ৩ টা নাগাদ আমাদের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হলো । বাংলাদেশী দুই বড় ভাই এর সাথে পরিচয় হলো ... তনু ভাই আর হাসান ভাই । অসম্ভব আন্তরিক দুইজন মানুষ । তারা দুই বন্ধু ছুটিতে ঢাকা থেকে তিনদিনের জন্য মেঘালয় ঘুরতে এসেছেন । তারাও পার্টনার খুঁজতেছিলেন আসলে । আমাদের জন্যও ভালো হলো । ৫ জন মিলে একটা গ্রুপ বানিয়ে নিলাম । বর্ডার থেকে ডাউকি বাজার আসলে খুব একটা দূরে না । আমরা হেঁটেই রওনা দিলাম । প্রচুর ক্ষুধা লেগে গিয়েছিলো সত্যি বলতে । ডাউকি গিয়ে আগে পেট ভরে খেয়ে নিলাম ৫ জন । খেয়ে-দেয়ে এবার একটু ভালো লাগছিলো । 

ডাউকি সমাচারঃ

ডাউকিতে দেখার মতো যতোগুলো স্থান রয়েছে তার সবগুলোকে গুগল ম্যাপে বসিয়ে এডিট করে এখানে এটাচ করলাম । এতে করে জায়গাগুলোর মাঝে সামঞ্জস্য করতে সুবিধা হবে আপনাদের। আমরা সবগুলোতে যাইনি । আপনারা যারা আগামীতে যেতে ইচ্ছুক তাদের সুবিধার্থে এটা করা । এখানে থেকেই একদম পূর্ণাঙ্গ ধারণা আপনি পেয়ে যাবেন । 

Dawki তে দেখার জন্য সর্বসাকুল্যে ১১ টা মেজর পয়েন্ট আমি নির্দেশ করলাম। এর বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই ডাউকিতে দেখার মতো । এখানে উল্লেখ্য স্থানগুলো হলোঃ 
১। নোহওয়েট ভিউ পয়েন্ট (Nohwet View Point),
২। সিঙ্গেল ডেকার লিভিং রুট ব্রীজ (Mawlynnong Living Root Bridge), 
৩। স্কাই ভিউ বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট (Sky View Bangladesh View Point),
৪। মাওলিনং ভিলেজ (Mawlynnong Village), 
৫। ব্যালান্সিং রক (Balancing Rock), 
৬। বিরডো ফলস (Byrdaw Falls), 
৭। বোরহিল ফলস (Borhill Falls),  
৮। উমক্রেম ফলস (Umkrem Falls), 
৯। উমগট রিভার (Umgot River), 
১০। স্নোনেংপেডেং ভিলেজ (Shnongpdeng Village), 
১১। ক্রাংসুরি ফলস (Krang Suri Falls).  

গুগল ম্যাপে নির্দেশিত ডাউকির সকল দর্শনীয় স্থান

উল্লিখিত স্থানগুলোর মধ্যে ১ থেকে ৫ নম্বরের মধ্যে নির্দেশিত পয়েন্টগুলো একদম কাছাকাছি । এখানে মাওলিনং ভিলেজ বাদে আমরা আর কিছু দেখিনি । আর এমন মেজর কিছুও না বাকিগুলো । যদি ডাবল ডেকারে যান তাহলে সিঙ্গেল ডেকার টা স্কিপ করতে পারেন সময় কম থাকলে । আর বোরহিল, উমক্রেম ও উমগট রিভার ব্রীজ একদম কাছাকাছি । ডাউকি থেকে শিলং বা চেরাপুঞ্জি যেতে হলে এই আটটি পয়েন্ট এর পাশে দিয়েই যেতে হবে । ক্রাংসুরিটা শুধুমাত্র ভিন্ন ডিরেকশনে পড়ে গেছে । গল্পে গল্পে সবগুলোর বর্ণনা পাবেন। 

উমগট রিভার হয়ে স্নোনেংপেডেং গ্রামঃ 

ডাউকি বাজারেই ছিলো স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বুথ । আমরা গিয়ে সেখানে থেকে রুপী তুলে নিলাম । প্রায় সাড়ে চারটার মতো বাজে তখন । এরপরে ৫ জন মিলে আমাদের এলোমেলো হয়ে যাওয়া ট্রিপের প্ল্যানটা পুণরায় ঝালিয়ে নিলাম । এরপরে আর কালক্ষেপণ না করে ৭০০ রুপীতে একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করে রওনা দিলাম উমগট রিভারের উদ্দেশ্যে । আজকে যে সময়টুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাতে আর বেশি কিছু দেখা সম্ভব না । আচ্ছা আপনারা উমগট রিভার টা চিনলেন তো ? জাফলং জিরো পয়েন্টে গিয়ে যে নদীটা দেখেন সেটাই আসলে উমগট রিভার । সেই সাসপেনশন ব্রীজটা আসলে উমগটের উপরেই নির্মিত । ডাউকি থেকে রওনা দিয়ে ১০-১৫ মিনিট পরেই চলে এলাম সেই সাসপেনশান ব্রীজের উপরে । প্রথমবারের মতো সেই ব্রীজের উপরে হাঁটলাম । এতোদিনে দেখা সেই স্বপ্নটা যেনো সত্যি হলো । ব্রীজের উপরে দাঁড়িয়ে জাফলং বেড়াতে আসা মানুষগুলোকে দেখছিলাম । কেমন অন্যরকম একটা অনুভূতি । 

সেখানেই রয়েছে নৌকার ঘাট । আমাদের এখনকার প্ল্যান হলো নৌকা নিয়ে নদীতে ঘুরবো আর গোসল করবো । নৌকা ভাড়া চায় অনেক । অনেক ক্যাচক্যাচি করে ৬০০ রুপীতে ফিক্স করলাম একটা নৌকা । যখন নৌকায় চড়ে বসলাম তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে । নদীতে গোসল করতে এতোই ভালো লাগছিলো যে সত্যি বলতে আর উঠতে ইচ্ছে করছিলো না । নদীর প্রবাহমান অগভীর, স্বচ্ছ, শীতল জলে নাইতে গিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি যেনো একদম উধাও হয়ে গেলো । মানে একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম । বিশেষ করে আমি আর সুফল । আমাদের পাগলামি টা দেখার মতো ছিলো । আসন্ন সন্ধ্যার পূর্বেই জল থেকে উঠে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো বাকিরা । অবশেষে ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে বাধ্য ছেলের মতো উঠে এলাম নৌকায় । ছোট্ট ডিঙি নৌকাটা একটু পরেই আমাদের ঘাটে এনে নামিয়ে দিলো । সাড়ে ছয়টার মতো বাজে । সূর্যের আলো নিভু নিভু করছে । নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমরা পূর্বে রিজার্ভ করা কারে এসে বসলাম । এবার গন্তব্য স্নোনেংপেডেং গ্রাম । 

উমগট রিভার এবং ডাউকি ব্রীজ 

সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে । আজকের মতো সূর্য চলে গেছে বিশ্রামে । গাড়ি এনে আমাদের নিঃশব্দে নামিয়ে দিলো স্নোনেংপেডেং গ্রামে । চারিদিকে সুনসান নীরবতা । প্রকৃতির নিজের শব্দগুলো বাদে নেই কোন কলকারখানার শব্দ, নেই কোন লাউড স্পিকারে মিউজিকের সাউণ্ড বা মানুষের তীব্র চিৎকার অথবা গাড়ির হর্ণের শব্দ । গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে আমরা একটা হোটেলের একটা রুমেই ৫ জন উঠে গেলাম । হোটেল ভাড়া এলো ১৮০০ রুপী । আসলে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় সেভাবে বেশি হোটেল দেখার সুযোগ পাইনি । ভাড়া একটু বেশি গেলেও প্রথমে যেটা দেখেছি, সেটাতেই উঠে গিয়েছি । 

হোটেলের লোকেশনটা অসাধারণ ছিলো । সত্যি বলতে এই জায়গাটাই অসাধাণ । এখানকার সবগুলো বাড়ি বা  হোটেল একদম প্রকৃতির সাথে এবং প্রকৃতির মাঝে অবিচ্ছিন্ন একটা হৃদ্যতা নিয়ে নির্মিত । আমাদের হোটেলের সামনেই উমগট নদী । অনবরত সেই নদীতে পানির স্রোতের তীব্র শব্দে কেমন একটা মাদকতা পেয়ে বসেছিলো যেনো আমায় । আমাদের হোটেলের ঠিক পাশেই উমগটের উপরে রয়েছে স্নোনেংপেডেং গ্রামের সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজটা । দুইটা পাহাড়ের মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছে নৈসর্গিক এই সাসপেনশন ব্রীজ । 

মেঘালয় যখন রওনা হই, তখন ঢাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিলো না । তাই মনের মাঝে একটা সংশয় রয়ে গিয়েছিলো আদৌ মেঘালয়ে গিয়ে বৃষ্টির দেখা মিলবে কিনা... ঝর্ণাগুলোর অবস্থাই বা কেমন! ডিনার শেষে  হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এই এলাকায় নাকি দৈনিক রাতেই বৃষ্টি হয় । এই কথা শোনার সাথে সাথেই মনটা একদম খুশিতে নেচে উঠলো যেনো । সারাটা দিন ইমিগ্রেশনে যে টর্চারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, এখানে এসে প্রতিটি কাজে, প্রতিটি দৃশ্যে, প্রতিটি কথায় এবং সর্বোপরি প্রকৃতির প্রতিটি আচরণে এতো বেশি আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম যে খুব সামান্যতেই গোটা দিনটা নষ্ট হবার কষ্ট ভুলে গেলাম । 

হোটেল মালিকের কথা অনুযায়ী একটু পরেই দেখলাম টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে । আনন্দ আর প্রাপ্তির পূর্ণতায় হৃদয় তখন একদম আচ্ছন্ন । সুফলকে নিয়ে ছাতা মাথায় নেমে গেলাম প্রায় অন্ধকার উমগটের তীরে । দেখলাম নদীর তীরে অনেকেই ক্যাম্পিং করেছে । তাঁবুর ভেতরে আলো জ্বালিয়ে তারা নিজেরাই গল্প করছিলো আর সম্ভবত টিপটিপ বৃষ্টি এবং খুব কাছে থেকে প্রচণ্ড স্রোতের আওয়াজ উপভোগ করছিলো । দূর থেকে আলোকোজ্জ্বল তাঁবুগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগে । বেশ আগ্রহ নিয়ে তাদের সাথে দুই বন্ধু কথা বললাম । তাদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছিলো স্নোনেংপেডেং গ্রামে উমগটের তীরে ক্যাম্পিং সত্যিই খুব সুন্দর একটা অপশন হতে পারে । তাঁবুর ভেতরে বৃষ্টির ছিটা লাগার কারণে বেশিক্ষণ এভাবে তাদের সাথে কথা বলতে পারলাম না । 

দুই বন্ধু নদীর জলে পা ভিজিয়ে স্রোতের তীব্র আওয়াজ শুনছিলাম আর নিজেরা গল্প করছিলাম । নদীর পরিষ্কার পানি পানও করলাম । দারুণ লাগছিলো সব মিলিয়ে । ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বৃদ্ধি পেলেও সেখানে থেকে হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না । কিন্তু ততোক্ষণে দুইজনে অনেকটাই ভিজে গেছি বৃষ্টিতে । বাধ্য হয়ে হোটেলে ফিরে আসতে হলো । রাত কয়টা বাজে খেয়াল নেই । তবে ঘুমানোর তাড়া রয়েছে । এর একমাত্র কারণ হলো ভোরের স্নোনেংপেডেং দেখা । সবাই মিলে ভোর পাঁচটার দিকে ওঠার প্ল্যান করে আজকের মতো ঘুমিয়ে গেলাম । 


আজকের খরচঃ (১৫/০৮/২০১৮)

১। বোটিং = ১২০ রুপী 
২। ট্যাক্সি ভাড়া = ১৪০ রুপী 
৩। হোটেল ভাড়া = ৩৬০ রুপী 
৪। খাবার খরচ = ১৩০ রুপী 
.........................................................
মোটঃ ৭৫০ রুপী (জনপ্রতি) 

(টাকার হিসাব টা ট্যুরের একদম শেষদিন এড করবো) 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

একাদশ পর্বঃ ১২,৮২৭ টাকায় ১২ দিনে ঢাকা থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ (বিশেষ পর্ব)