সপ্তম পর্ব (একদিনে দিল্লি ভ্রমণ )
আজকে নিলয় আর আমাদের সাথে বের হলো না । তাসিন আর সুফল কে সাথে নিয়ে আমি দিল্লি ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লাম । আসলে দিল্লি ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকদের জন্য সেখানে সুন্দর কিছু ব্যবস্থা আছে । অবস্থা বুঝে ১৫০ রুপীতে সাধারণ বাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন মূল্যের এসি বাস, হাইস, কোস্টার এবং কারে প্যাকেজ ব্যবস্থা আছে যারা শুধুমাত্র দিল্লি ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকদের নিয়ে ডে ট্রিপে দিল্লির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ায় । বিভিন্ন এজেন্সি এসব ব্যবস্থা করে থাকে । আর হোটেল মালিকদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে তারা পর্যটক সংগ্রহ করে । সত্যি বলতে একদিনের হিসেবে ব্যবস্থাটা আমার খুবই ভালো লেগেছে । ব্যক্তিগতভাবে বেড়ালে হয়তো কিছু স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু একদিনে সবকিছু কাভার করা সম্ভব হতো না । আমাদের ঢাকাতে এমন কোন ব্যবস্থা কখনো নজরে পড়েনি । অথচ দিল্লির পথে ট্যুরিস্টদের জন্য আলাদাভাবে নির্ধারিত এই ট্রান্সপোরটারগুলো হরহামেশাই নজরে পড়ে ।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রাচীর-বেষ্টিত পুরনো দিল্লি শহরে মুঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি দুর্গ এটি। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্গটি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী । ২০০৭ সালে লাল কেল্লা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের একটি শক্তিশালী প্রতীক । প্রতি বছর ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল কেল্লার লাহোরি গেট সংলগ্ন একটি স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে থাকেন।
যাহোক, সকালে দ্রুত হালকা খাওয়াদাওয়া করে নয়টায় আমরা হোটেলের সামনে থেকে আমাদের নির্ধারিত বাসে উঠে পড়লাম । বাস শুরুতেই নিয়ে গেলো লালকেল্লায় । লালকেল্লা বেড়ানোর জন্য আমাদের এক ঘণ্টা সময় দেয়া হলো । আমরা ৩৫ টাকা হারে টিকিট সংগ্রহ করে দ্রুত ঢুকে গেলাম ভেতরে । ভালোই লাগছিলো দেখতে । দেখছিলাম আর সেই শাহজাহানের কথা ভাবছিলাম । ঘণ্টাখানেকের মাঝে ফিরে এলাম বাসে । এসব বাসের একজন দিকনির্দেশক থাকেন যিনি চলন্ত বাসে দাঁড়িয়েই পরবর্তী স্পট সম্পর্কে আগেই বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সবাইকে সহযোগিতা করে থাকেন ।
এরপর সেখানে থেকে চলে গেলাম গান্ধী মিউজিয়ামে । গান্ধীর লাইফ সাইকেল দেখলাম । ভালোই লাগছিলো । অনন্য একজন মানুষ ছিলেন । যে সময়ে অস্ত্র ছাড়া কেউ কথা বলে না, সেই সময়ে গান্ধী কথা বলেছিলেন অস্ত্র ছাড়া আর সেই ভয়েসটা এতো বেশি জোরালো ছিলো যে বৃটিশদের ভিত নড়ে উঠেছিলো ।
গান্ধী মিউজিয়াম |
৩। ইন্ডিয়া গেট(India Gate)
গান্ধী মিউজিয়াম দেখা শেষে চলে গেলাম ইন্ডিয়া গেটে । এখানে প্রচুর ভিড় থাকে সবসময় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত ৯০,০০০ ভারতীয় সেনা জওয়ানদের স্মৃতিরক্ষার্থে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয় ১৯৩১ সালে । এটি লাল ও সাদা বেলেপাথর ও গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি । এই ইন্ডিয়া গেটের কত নাম শুনেছি, আজকে চাক্ষুস করে ভালো লাগলো । সেখান থেকে বাসের কাছে ফিরে দেখি এক লোক কি এক লাড্ডু বিক্রি করছে, নাম বলছে দিল্লিকা লাড্ডু । ১০ রুপি হারে তিনজন খেলাম । খারাপ না ।
ইন্ডিয়া গেট |
ইণ্ডিয়া গেট |
দিল্লিকা লাড্ডু |
৪। রাষ্ট্রপতি ভবন (The Rashtrapati Bhavan/Presidential Residence)
সেখানে থেকে সোজা চলে গেলাম রাষ্ট্রপতি ভবনে । ব্রিটিশ শাসনকালে এই প্রাসাদটি ছিল ভারতের ভাইসরয়ের সরকারি বাসভবন। এই সময় এটি "ভাইসরয়'স হাউস" নামে পরিচিত ছিল। ১৯৫০ সালে প্রাসাদটি রাষ্ট্রপতি ভবন নামে পরিচিতি লাভ করে । সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে গেলাম কুতুব মিনারে ।রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে |
৫। কুতুব মিনার (Qutub MInar)
বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার । ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে। ভারতীয় মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বলে কুতুব মিনার বেশ উল্লেখযোগ্য ।এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাবদ্ধ হয়েছে।
সুফলের পেছনে কুতুব মিনার |
৬। লোটাস টেম্পল(Lotus Temple)
এটি বাহাইদের উপাসনাস্থল । এই মন্দিরটি পদ্মের মত দেখতে বলে একে 'লোটাস টেম্পল' বলে। যাহোক, কুতুব মিনার থেকে সোজা চলে এলাম লোটাস টেম্পলে । এখানেও সেইম অবস্থা । প্রচুর ভীড় । আসলে হয়েছে কি সেদিন ছিলো শুক্রবার । তাই সবগুলো ট্যুরিস্ট স্পটে এতো ভীড় । এখানেও ঢোকা হলো না । বাইরে থেকেই দুই-একটা পিক তুলে বিদায় নিলাম।লোটাস টেম্পল |
৭। নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার- (Nizam Uddin Auliya Mazar)
সেখানে থেকে বাসে করে চলে গেলাম নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে । ৫ রুপী জোড়া হারে গেটে জুতা রেখে ভেতরে প্রবেশ করলাম । এখানে গিয়ে সত্যিই আমি আশাহত হয়ে পড়েছিলাম । উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই মানুষটির মাজার আজ বিদয়াতে পরিপূর্ণ । আমি সারাজীবন ইসলাম নিয়ে যে শিক্ষাগুলো অর্জন করেছি, ওখানে গিয়ে সবাইকে একচেটিয়া উলটো কাজ করতে দেখে কনফিউজড হয়ে গেছি – আমি ঠিক না ওরা ? আহত মনে ফিরে এলাম বাসে ।
পরিশিষ্ট দিল্লিঃ
দিল্লি ভ্রমণের এটিই ছিলো আমাদের শেষ জায়গা । এরপর বাস সোজা জামে মসজিদে চলে গেলো । জামে মসজিদের পাশে মিনাবাজারে নেমে ঘুরতে লাগলাম । এখানে কেনাকাটার মতো সুন্দর সুন্দর কিছু জিনিস দেখলাম । একজায়গায় দেখলাম ওজন করে গরুর মাংস+বাসমতি চালের বিরিয়ানী বিক্রি হচ্ছে । ৩০ টাকা হারে এক প্লেট করে নিলাম তিনজন । ভালোই লাগলো খেয়ে । বাংলাদেশে এর দাম কত হতো সেটা ভেবেই তিনজন কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম । সেখান থেকে বের হয়ে এক জায়গায় দেখলাম একটা পানীয় বিক্রি করছে, নাম “kesar milk” । ৪০ রুপী হারে খেলাম ।
ওজন করে বিক্রি করা বাসমতি চালের বিরিয়ানী |
![]() |
kesar milk |
ভালোই লাগলো খেয়ে । আসলে এক্সপেরিয়েন্স করার মতো নতুন অনেক খাবারই সেখানে ছিলো । কিন্তু পকেটের কথা চিন্তা করে দমে যেতে হয়েছে । এরপর আরো কিছুক্ষণ এদিক সেদিক বেড়িয়ে একেবারে রাতের খাবার শেষ করে হোটেলে ফিরলাম ।
খরচঃ(৩০/০৩/১৮)
ব্রেকফাস্ট = ২১/-
দিল্লি ভ্রমণ = ১৫০/-
লালকেল্লা প্রবেশ ফি= ৩৫/-
দিল্লিকা লাড্ডু= ১০/-
দুপুরের খাবার = ৬১/-
মাজারে জুতা রাখা = ৫/-
বাসমতি চালের বিরিয়ানি = ৩০/-
kesar milk = ৪০/-
ডিনার = ৫৫/-
মোটঃ ৪০৭/-
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন