ষষ্ঠ পর্ব (মানালি থেকে দিল্লি )
সমস্যা দেখা দিলো আজকের দিনটি নিয়ে । কোন প্ল্যান নেই । সাইট সিয়িং নিয়ে কারো কোন হেডেক নেই । নিলয় আর তাসিন আজকের সারাদিন নাকি হোটেলেই থাকবে, তারা টায়ার্ড হয়ে গেছে এই কয়দিনের জার্নিতে । আর সুফল কুল্লুতে প্যারাগ্লাইডিং করার জন্য যাবে । আমি হয়ে গেলাম একা । বেড়াতে গেলে আমার ক্লান্তিও আসেনা, আর ঘরে বসে সময় নষ্ট করা টাইপ ইচ্ছেও নেই । কিছু না কিছু দেখবোই । কি করবো না করবো ভাবতেই সুফল ওর সাথে কুল্লুতে যাবার জন্য ধরলো , আমার ভাড়া সে নিজেই দেবে । সে প্যারাগ্লাইডিং করবে আর আমি দর্শক । কিছু না করে হোটেলে বসে থাকার চেয়ে সুফলের সাথে গিয়ে স্পেক্টেটর আয়ন টাইপ আচরণ করাও ভালো । রাজি হয়ে গেলাম । মানালি থেকে কুল্লু প্রায় সোয়া এক ঘন্টার পথ; বাস ভাড়া ৩০ টাকা । কুল্লুতে গিয়ে শুনি আবহাওয়া খারাপের কারণে প্যারাগ্লাইডিং করা সম্ভব না তখন । অগত্যা বেগাড় খাটনি গেলো এতোগুলো সময় । যারা মানালিতে প্যারাগ্লাইডিং এর জন্য যেতে আগ্রহী তারা আগে থেকেই এসব ব্যপারে খুটিনাটি জেনে যাবেন । অন্তত মানালি পৌঁছেই কনফার্ম হয়ে নেবেন । তা না হলে আমাদের মতো বেহুদা খাটা লাগতে পারে । আবহাওয়ার ব্যাপার টা ওদের কাছে থেকেই জেনে তারপরে বের হবেন । কুল্লুতে প্যারাগ্ল্যাইডিং করায় এমন একটি এজেন্টের কন্ট্যাক্ট নাম্বার দিলাম । ৯৮৫৭৭০৬০০০ এবং ৯৮৮২০৯৭৯৯১ । আপনি ওদের সেবা গ্রহণ করেন বা না, তথ্য চেয়ে ফোন দিতেই পারেন । আমি যতদূর দেখেছি, ব্যবহারের দিক দিয়ে তারা মানুষ হিসেবে খুবই অমায়িক । যাহোক, আমরা ওখানে কোন সুবিধা করতে পারলাম না । বাধ্য হয়ে শহরে ফিরে এলাম ।
আপেল ফুল থেকে মৌমাছির মধু সংগ্রহকরণ |
বন বিহার (Van Vihar Manali)
তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে । তাসিন আর নিলয়ের সাথে যোগাযোগ করে আমরা শহরে মিলিত হয়ে দুপুরের খাবার খেলাম । দিনটা বেহুদা গেলো বলে আমার বেশ খারাপই লাগছিলো । দুপুরের খানা শেষে নিলয় চলে গেলো হোটেলে আর আমরা তিনজন চলে গেলাম শহরের নিকটেই অবস্থিত বন বিহারে । হাতে সময়ও খুব বেশি নেই । বন বিহার জায়গা টা আমার খুবই ভালো লেগেছে । চারিদিক শুধু সুউচ্চ পাইন গাছ । দারুণ নীরব একটি জায়গা । প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা এই বন বিহার । ওখানে গিয়ে সেই পোজটোজ দিয়ে কিছু ফটো তুললাম ।
![]() |
বন বিহার |
বন বিহার - প্রশান্তিকর একটি জায়গা |
বন বিহার |
ভালো লেগেছে জায়গাটা খুব । একাকী নিজেকে কিছু সময় দেবার জন্য দারুণ একটি জায়গা এটি । একটু পর পর রাস্তার পাশে সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে, একটু পর পর স্পিকার লাগানো আছে যে স্পিকারে আবার অনবরত আস্তে আস্তে নীরব টাইপ সুন্দর সুন্দর গান বাজতেছে । অনেক কাপল দেখলাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, পিক ওঠাচ্ছে । আমরা তিনজন নিজেদের মতো কিছুক্ষণ ঘুরে চার টার দিকে হোটেলে ফিরে এলাম ।
মানালি থেকে দিল্লি অভিমুখে -
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দিল্লিগামী বাসে উঠে পড়লাম । বাস ঠিক সময়মতো মানালি ত্যাগ করলো । আবার সেই একই পথ ধরে মাণ্ডি হয়ে বাস ছুটে চললো দিল্লির দিকে । বলে রাখা প্রয়োজন, আমরা সিমলা থেকে মানালি দিনে এসেছিলাম শুধুমাত্র পথের সৌন্দর্য দেখার জন্য । কিন্তু হিসেব সব গড়মিল হয়ে গেছে । একই পথ বেশ কয়েকবার দেখলাম । সিমলা থেকে মানালি আসার পথে, কুল্লু আসা-যাওয়ার সময়ে এবং দিল্লিতে যাওয়ার সময়ে ।
মানালি থেকে দিল্লি অভিমুখে |
গতদিনে তো কারে করে আরো সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে গুলাবা আর সোলাং ঘুরেছি । সুতরাং আজকে দিল্লিতে যাবার সময়ে সেই একই দৃশ্য দেখে আহামরি কিছু মনে হচ্ছিলো না। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো আপনি ট্যুরের লেন্থ কমাতে চাইলে সিমলা থেকে রাতেও আসতে পারেন মানালিতে - যদি ইচ্ছে এবং শারীরিক সক্ষমতা থাকে । রাস্তার সৌন্দর্য দেখতে চেয়ে দিনে আসতে চাওয়ার ব্যাপার টা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ কিছু না । আর তাছাড়া এই রাস্তায় লিনিয়ার আর রোটেটিং মোশনের মিশ্রণে এমনিতেও আপনার ওয়াও টাইপ ফিল আসার কথা না । অবশ্য খুব বেশি সক্ষম হলে আলাদা কথা । আশা করি আমার এতো কথা বলার উদ্দেশ্যটা পাঠকের বোধগম্য হয়েছে ।
যাহোক, দিল্লি যাচ্ছি তো যাচ্ছিই । মোট প্রায় ১৩ ঘণ্টার জার্নি ছিলো এটা । সেরকম কিছু এনজয় করতে পারিনি এবারে । যদিও পাহাড়ের গায়ে গায়ে গড়ে ওঠা বাড়িতে জ্বলা ইলেক্ট্রিক লাইটের আলোগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো জোনাকি পোকা জ্বলছে । এই ব্যাপার টা ভালো লেগেছে । রাস্তায় একজায়গায় বিরতি দিয়েছিলো ।আমি দুইটা কমলালেবু কিনেছিলাম সেখানে থেকে । আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না । কমলালেবু খেয়েই আরো ঝামেলা বাড়ালাম । এবার সত্যিই গাড়ির এই ভ্যারিয়েবল মোশনের চক্করে পড়ে বমি করে ফেললাম । সেই শৈশবে কবে বাসে উঠে বমি করেছিলাম মনে পড়েনা কিছু । নিজেকে শক্ত ট্রাভেলার ভাবতাম এতোদিন । কিন্তু এবার আর সেই কনফিডেন্স কাজে দিলো না । বমি করে বেশ দুর্বল বোধ হচ্ছিলো । ঘুমিয়ে গেলাম । কেউ এই সমস্যাটা এড়াতে মেডিকেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন আগে থেকেই । অথবা মানালি থেকে দিল্লি অভিমুখী আরো ভালো ডিলাক্স বা ভলভো টাইপ বাসে উঠতে পারেন । কিছু খরচ বেশি হলেও তুলনামূলকভাবে শান্তিতে ভ্রমণ করতে পারবেন । ডু এজ ইওর ক্যাপাবিলিটি ।
খরচঃ
দুপুরের খাবার = ১১২/-
বন বিহারের টিকিট = ২০/-
কমলালেবু = ২০/-
মোট = ১৫২/-
দিল্লিতে ১ম দিন (২৯-০৩-১৮)
সকাল সাতটার সময়ে দেখি বাস দিল্লি কাশ্মীর গেটে এসে গেছে । বাস থেকে নেমে কলকাতার ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য সিএনজি নিয়ে সোজা চলে গেলাম দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে । আমাদের রেলস্টেশনের যে পাশে নামিয়ে দিয়েছে সেই পাশের ঠিক অপজিটে ইন্টাঃ ট্যুরিস্ট ব্যুরো অফিস যেখানে বিদেশি কোটায় টিকিট কাটা যায় । ফুটওভার ব্রীজ ধরে হেঁটে হেঁটে সুবিশাল স্টেশনের পুরোটা পার করে সেখানে পৌঁছাতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেলো । এই কাউন্টারের পাশের জায়গাটার নাম হলো পাহাড়গঞ্জ । আপনারা সিএনজিতে উঠে চালককে বলে দেবেন পাহাড়গঞ্জের কথা । তাহলে বেহুদা সুবিশাল স্টেশনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা এতো খাটাখাটি করে যেতে হবে না । আর আমরা এখানে সিএনজিতে উঠে এই ট্যুরে প্রথম মামু সেজে গেছি । ভাড়া অনেক বেশি নিয়েছে । সুতরাং স্বচ্ছভাবে কথা বলে নেবেন আগেই । সেখানে গিয়ে দেখি ৩০ তারিখের কোন টিকিট অবশিষ্ট নেই । বাধ্য হয়ে ৩১ তারিখ বিকেল ৫.৩৫ এর পূর্বা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটতে হলো । বলে রাখি, টিকিট কাটা শেষে ট্রেনের নাম, ডিপারচার টাইম, ডিপারচার প্ল্যাটফর্ম, আসন সহ টিকিটের উপর লেখা সকল তথ্য একেবারে ভালোভাবে কনফার্ম হয়ে নেবেন । ওদের দূর পাল্লার ট্রেনের টিকিটের উপর দেয়া তথ্যগুলো এতো হাবিজাবি লেগেছে যে এট এ গ্লান্স বোঝা যায় না। সমস্যা হলে হেল্প ডেস্ক থেকে ভালো করে বুঝে নেবেন । কাজ শেষ করতে করতেই প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো । স্টেশন থেকে বের হয়ে নিকটস্থ একটি মুসলিম হোটেল খুঁজে বের করে আবার সেই কলকাতার মত ৩৫ টাকা বাটি হারে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম । এরপর সেখানে থেকে অটোতে করে চলে গেলাম ওল্ড দিল্লি জামে মসজিদে । সেখানে সব মুসলিম হোটেল(খাবার+আবাসিক) । একটা খুঁজে বের করে উঠে গেলাম সেখানে । দুই রাতের জন্য মোট ভাড়া গেলো ১৮০০ রুপী । হোটেলে গিয়েই ১৫০ রুপীতে ডে ট্রিপে দিল্লি ভ্রমণের অফার পেলাম । আসলে এমনিতেও ঝামেলা নিতে ইচ্ছে করছিলো না । তাই ঝামেলামুক্ত এই অফারটা খুব পছন্দ হলো । যাহোক, সেখানে উঠে ফ্রেশ হয়ে দিলাম ঘুম । শরীর কিছুটা স্বস্তি পেলো। গতরাতে বাসে বেশ ঝক্কি গেছে ।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চারজন বেড়িয়ে পড়লাম কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে । যাবো কোন একটা বিগবাজারে । ওরা কিনবে, আমি দেখবো - কারণ আমার কিছু কেনার ইচ্ছে ছিলো না । জামে মসজিদের ওখান থেকে মেট্রোতে চেপে ৩০ রুপী পার পারসন হারে চলে গেলাম রাজিব চকে । সেখানে নেমে একটা বিগ বাজার পেলাম, তাও বন্ধ । অগত্যা ফের পথে নামতে হলো । পথে হালকা খানাপিনা হলো । এরপর প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হলো। নিলয় আর তাসিনের পাল্লায় পড়ে এবার সত্যিই বিরক্ত লাগছিলো । হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম । এরপর অনেক কষ্টে আরেকটা বিগ বাজার পেলাম । দ্রষ্টব্য- বিগবাজারে তুলনামূলকভাবে স্বল্প মূল্যে মোটামুটিভাবে ঘর-সংসারের সকল পণ্য পাওয়া যায় । কেনাকাটার ইচ্ছে থাকলে এখানে আসতে পারেন । এরপর আবার সেই রাজিবচক থেকে মেট্রোতে চেপে জামে মসজিদে ব্যাক করলাম । এখানে এসে একটা মুসলিম হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম । খেয়ে হোটেলে ফিরে যা করার তাই করলাম ।
খরচঃ
কাশ্মীর গেট – ইণ্টা. ট্যুরিস্ট ব্যুরো(সিএনজি)= ৮৫/-
দিল্লি-কলকাতা(ট্রেন) = ৯২০/-
দুপুরের খাবার = ৬২/-
রেলস্টেশন – জামে মসজিদ = ২৫/-
হোটেল ভাড়া = ৪৫০/-
জামে মসজিদ- রাজিবচক (মেট্রোতে আপ-ডাউন)= ৩০+৩০/-
ডিনার = ৫০/-
সারাদিন আজাইরা কিছু খরচ = ৪৬/-
takar hishab apnara ekbar rupee ekbar takae dicchen. ektu kosto hocche track rakhte
উত্তরমুছুন