অষ্টম পর্ব (দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা)
আজ আর কোন প্ল্যান নেই । ঢাকায় ফিরতে হবে এটাই একমাত্র প্ল্যান । অনেক কাজ জমে গেছে দেশে । সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেল থেকে চেক আউট করলাম । এরপর সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে । সেখানেই আড্ডা দিয়ে দুপুরে খেতে গেলাম আমাদের পূর্ব নির্ধারিত মুসলিম হোটেলে । আসলে আমরা যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই এরকম একটি করে হোটেল খুঁজে বের করে রেখেছি । সেই এলাকায় গেলে সেখানেই খেয়েছি । লাঞ্চ শেষ করে রাতের জন্য সেখান থেকেই খাবার পার্সেল নিলাম । যথাসময়ে ট্রেনে উঠে গেলাম। ট্রেন একেবারে ৫.৩৫ এ প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করলো , শুরু হলো ১৪৭০ কিলোমিটার দূরের কলকাতা শহর অভিমূখে যাত্রা । পথিমধ্যে উত্তর প্রদেশ থেকে পুরান ঢাকার দুই মা-ছেলে আমাদের পাশের আসনে উঠে বসলো । তারা তাজমহল দেখে কলকাতা যাচ্ছে । বাংলাদেশি মানুষ পেয়ে ভালোই লাগলো । আড্ডায় আড্ডায় সময়গুলো কেটে গেলো ।
খরচঃ(৩১/০৩/১৮)
ব্রেকফাস্ট = ২৫/-
জামে মসজিদ-নিউ দিল্লি রেলস্টেশন (সিএনজি) = ৪০/-
দুপুরের খাবার = ৬২/-
পার্সেল ৭০/-
মোটঃ ১৯৭ রুপী
সারাদিন পূর্বা এক্সপ্রেসে (০১/০৪/১৮)
আজকের সারাদিন ট্রেনেই কেটে গেলো । আমার কাছে ট্রেনের চেয়ে বাসেই জার্নি বেশি ভালো লাগে সবসময় । ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে এতো লং টাইমের ট্রেন জার্নির কথা ভেবে কিছুটা খারাপই লাগছিলো । কিন্তু ওখানে এই স্লিপার সিটগুলোতে শুয়ে শুয়ে, আড্ডায় আড্ডায় যাওয়া এতোটা মজার ছিলো যে শেষমেশ সুফলের সাথে প্ল্যানই করে ফেললাম ইন্ডিয়াতে শুধুমাত্র ট্রেনে চেপে ঘুরে বেড়ানোর জন্য হলেও আসা যায় । সারাদিন আর সেভাবে ভারি কিছু খাওয়া হলো না । জেলী,পাউরুটি, সমুচা, চা ইত্যাদি হাবিজাবি খেয়েই দিন কেটে গেলো । ২৬ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ট্রেন এসে হাওড়াতে পৌছালো ।
হাওড়াতে নেমেই দেখি ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে । প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পরে বৃষ্টি থামলে আমরা প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে আমাদের রাতের খাবার পর্ব শেষ করে বাস ধরে সোজা চলে গেলাম শেয়ালদহ স্টেশনে । শেয়ালদহ পৌঁছে দেখি রাত সাড়ে দশটা বাজে । বনগাঁ অভিমুখী পরবর্তী ট্রেন একটা রাত ১১.২০ এবং আরেকটি রাত ৩.১৫ তে । আগের ট্রেনে গেলে বনগাঁ স্টেশনে রাত কাটাতে হবে, পরের ট্রেনে গেলে শেয়ালদাহ । নিরাপত্তার কথা ভেবে শেয়ালদহ - তেই থেকে গেলাম । রাতে প্ল্যাটফর্মেই ঘুমানোর প্ল্যান করছিলাম অন্যদের মতো করে । কিন্তু এক লোক আমাদের বাইরের হিসেবে চিনতে পেরে সতর্ক করে দিলো – দাদা এখানে ঘুমাবেন না, ঘুম থেকে উঠে কিন্তু একটা সামানও খুঁজে পাবেন না । আর ঘুমানো হলো না তাই । যথাসময়ে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম ।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, আপনাদের মনে হতে পারে আমরা কেনো এই রাতে হোটেলে থেকে পরদিন ভোরের ট্রেনে বনগাঁ হয়ে বর্ডারে গেলাম না । আসলে ২ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের ঢাকায় থাকাটা মূল লক্ষ্য ছিলো । হোটেলে থেকে পরদিন ভোরে রওনা হলে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বেনাপোল থেকে ঢাকা-র বাসে উঠতেই বেলা ১১ টা বেজে যেতো কমপক্ষে । তখন বাসে উঠলে ঢাকায় পৌঁছাতে রাত ১২ টা বাজতো । আরেকটা কথা হলো, আমি যতদূর জানি সকাল ১০ টার পরে বেনাপোল থেকে পরবর্তী বাসগুলো ছেড়ে যায় বিকেলের দিকে । এর মানে ঢাকায় থাকতে হবে পরদিন ভোরে । এসব কিছু বিবেচনা করেই আমাদের প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করতে হলো ।
খরচঃ(০১/০৪/১৮)
সারাদিনের হাবিজাবি খাবার= ৪০/-
ডিনার = ৫০/-
হাওড়া-শেয়ালদাহ(বাস) = ১২/-
শেয়ালদাহ-বনগা (ট্রেন) = ২০/-
বনগাঁ – বর্ডার (অটো ভাড়া) = ৪২/-
মোটঃ ১৬৪ রুপী
কলকাতা থেকে বর্ডার পার হয়ে ঢাকা - (০২/০৪/১৮ )
ট্রেন যখন বনগাঁতে পৌঁছায় তখন ভোর ৫ টা বাজে । সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে যাবো বর্ডারে । নরমালি এই ভাড়া যেখানে ৩০ রুপী, সেখানে ভোরবেলায় এই ভাড়া নাকি ৫০ রুপী । পরে চারজনে ১৭০ রুপীতে একটা সিএনজি নিয়ে চলে এলাম বর্ডারে ।(এখানে থেকে টাকায় হিসাব শুরু, টাকা আর রুপীর ঝামেলা এড়াতে এই অটো ভাড়াটি আমি ১ তারিখের খরচের সাথে দিয়ে দিলাম।) এসে দেখি আমাদের সামনে অলরেডি ২০ জন দাঁড়িয়ে গেছে । সাড়ে ছয়টার দিকে ইমিগ্রেশনের কাজ শুরু হলো । এক দালাল এসে আমাদের চারজনের কাছে ৮০০ টাকা চাইলো । দিতে অস্বীকৃতি জানালে সে ভেতরে কাকে যেনো ডাক দিয়ে বলে দিলো এই চারজনের ব্যাগ যেনো ভালো করে সার্চ করা হয় । আসল কথা হলো, হয় টাকা দে, নাহলে ব্যাগের জিনিসপত্র এলোমেলো করে ফেলবে । অথচ সেই লোক আমাদের চারজন বাদে আর কারো কাছে টাকা চাইছেও না + ভেতরে সেভাবে চেকিং ও হয় না । তাসিন বো**দা হুট করেই কাউকে কিছু না বলে একটি ১০০০ টাকার নোট বের করে দিলো । লোকটা ২০০ টাকা ফেরত দিলো । আমি বলে কয়ে আরো ১০০ টাকা ফেরত নিলাম । তাসিনের উপর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো । সমস্ত ট্রিপে সবকিছু দরদাম করেছি আমি আর নিলয়, তারপরে পে করেছি । আর এখন বালের বলদামার্কা পোলাপানের জন্য মারা খাওয়া লাগলো । ধুরু, মন মেজাজ দুইটাই খারাপ হয়ে গেলো । পুরো ট্রিপে দ্বিতীয়বারের(প্রথমবার দিল্লি কাশ্মীর গেটে) মতো মামু সাজলাম । টাকা খরচ তো বড় কথা না, বড় কথা হলো খরচের ক্ষেত্র । একজন এসে দুইটা কথা বলবে, আর পকেট থেকে টাকা বের করে দেবো – এটা আমি কখনোই করি না । আর বাজেট ট্রাভেলার হিসেবে এরকম করলে বাজেটও ঠিক থাকেনা ।
মন+মেজাজ খারাপ করে ইন্ডিয়ার ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে ওদের তিনজনের সাথে দূরত্ব রেখে আমি বাংলাদেশের লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম । পাসপোর্ট চেকার পুলিশের হাতে দিতেই বাইঞ্চোদ পুলিশ সেটা সরাসরি দালালের হাতে পাস করে দিলো । পুলিশের উপর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো । আবার কিছু টাকা যাবে । দালাল খুব দ্রুত কাজ শেষ করে আমার কাছে ২০০ টাকা চাইলো । আমি ইনিয়ে বিনিয়ে ৬০ টাকা দিয়ে কাজ সারলাম ।
সকল ঝামেলা শেষ করে ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বেড়িয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়ে রিলাক্স হলাম । কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব কাজ করছিলো ভেতরে । এখানে নিঃশ্বাস নেয়াটাও কত আনন্দের বোধ হচ্ছিলো । আহ আমার দেশ, প্রিয় বাংলাদেশ । আমার জন্মভূমি, আমার মা থাকে এই দেশে । কি শান্তি ! কি শান্তি ! এই প্রথম এই অনুভূতির সাথে পরিচয় । অন্যরকম ভালোলাগা ।
শান্তির ভাবেই মন, মেজাজ ভালো হয়ে গেলো । ফোন খুলে বাংলাদেশি সিম ভরলাম । আধাঘণ্টা পরে বলদ তিনটা বের হলো । এবারও ওদের কাছে থেকে ২০০ টাকা করে নিয়েছে । ওদের থেকে আলাদা হয়ে একাই এসেছি বলে + বলদামির জন্য ওরা আবার বাঁশ খেয়েছে বলে এবার ভালো লাগলো মনে মনে । সিনক্রিয়েট করলাম না । সাড়ে সাতটা বাজে । ওখানেই দেখলাম সব ঢাকাগামী বাসের লোকজন যাত্রী খোঁজাখুঁজি করছে । দেশ ট্রাভেলসের আটটার বাসের চারটা টিকিট কেটে ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে উঠলাম । বাস নির্বিঘ্নে চলা শুরু করলো । বাসে উঠেই লম্বা একটা ঘুম দিলাম । ঘাটে গিয়ে প্রায় চারঘণ্টা বাস দাঁড়িয়ে ছিলো । সেখানেই হালকা নাস্তা করলাম । ভারী কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো না। ঢাকায় আসতে আসতে প্রায় রাত সাড়ে সাতটা বেজে গেলো । সারা রাস্তা ঘুমিয়েই এলাম । রাতজাগার ফলাফল অনেকটাই প্রশমিত হলো । গাবতলী বাসস্ট্যাণ্ডে নেমে যে যে যার গন্তব্যে চলে গেলাম আমরা । আর এর সাথে আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত ভারত ভ্রমণের ইতি হলো ।
খরচঃ(০২/০৪/১৮ )
ইন্ডিয়ান বর্ডারে মামু সাজা = ১৭৫/-
বাংলাদেশের বর্ডারে = ৬০/-
ব্রেকফাস্ট = ২৫/-
বেনাপোল – ঢাকা = ৫০০/-
হালকা নাস্তা = ২০/-
মোট = ৭৮০/-
৭৭.৮০ রুপী হারে ৭৮০টাকা = ৬০৬ রুপী
এখন ২২ তারিখ থেকে শুরু করে ২ তারিখ অবধি মোট খরচ=
২২/০৩/১৮ = ২৫২৩/-
২৩/০৩/১৮ = ৩২৫/-
২৪/০৩/১৮ = ১২০/-
২৫/০৩/১৮ = ৪২০/-
২৬/০৩/১৮ = ৬৮৭/-
২৭/০৩/১৮ = ২০১৮/-
২৮/০৩/১৮ = ১৫২/-
২৯/০৩/১৮ = ১৬৯৮/-
৩০/০৩/১৮ = ৪০৭/-
৩১/০৩/১৮ = ১৯৭/-
০১/০৪/১৮ = ১৬৪/-
০২/০৪/১৮ = ৬০৬/-
মোট = ৯,৩১৭ রুপী
১০০ টাকায় ৭৭.৮০রুপী হিসেবে ৯,৩১৭ ভারতীয় রুপী = ১১,৯৭৫ বাংলাদেশী টাকা
অর্থাৎ ২১মার্চ’১৮ তারিখে রাতের বাসে ঢাকা ত্যাগ করে ১২ দিনের ভারত সফর শেষে ২এপ্রিল’১৮ তারিখ রাতে ঢাকায় পৌঁছাতে আমাদের জনপ্রতি মোট খরচ হয় ১১,৯৭৫ টাকা ।
দ্রষ্টব্যঃ পুরো ট্রিপের ভেতরে সিমলা থেকে শুধু আমার দুইটা চাদর কেনার খরচ এড করা হয়নি । আর এমনিতেও কেউ কেনাকাটা করতে চাইলে তার খরচ যেকোন রকম হতেই পারে । ট্যুর আর শপিং দুইটা আলাদা ।
পরিশিষ্ট ঃ
সারকথায় উপরের কিছু তথ্য একজায়গায় তুলে ধরছি -
অনেক কষ্ট করে প্রতিটা তথ্য-উপাত্ত এবং নির্দেশনা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি । আশা করছি যারা কম খরচে সিমলা-মানালিতে বেড়াতে যেতে ইচ্ছুক, তাদের খুবই উপকারে আসবে লেখাটি । তবে একটা কথা মনে রাখবেন, প্রতিটা ট্যুরই ইউনিক । কখনোই শতভাগ মিলবে না। সুতরাং আগে থেকেই সেই চিন্তাটা মাথায় রাখবেন । কাউকে অন্ধভাবে অনুকরণ করে ট্যুর না দেয়াই বেটার । এছাড়া আর যেকোন তথ্য প্রয়োজন হলে আমি তো Facebook - এ আছিই । ভারত ভ্রমণের অতিরিক্ত পিক দেখতে চাইলে আমার ফেসবুকে আপলোড দেয়া Discovering India এবং সিমলা+মানালি ভ্রমণের এলবামগুলো ঘুরে দেখতে পারেন । এছাড়া যেকোন প্রয়োজনে নক দিতে পারেন । বলে রাখি, মেসেঞ্জার ফিল্টারের মেসেজ সবসময় চেক করা হয় না । সেক্ষেত্রে ফেসবুকে আমার ভারত ভ্রমণের কোন একটা এলবামে কমেন্ট করে ইনবক্সে আসতে বললেই হবে । আপনার ট্যুর খুব সুন্দর, নিরাপদ এবং পরিবেশ বান্ধব হোক - শুভ কামনা ।
আমি ফাহিম,
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়,
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ।

very much impressive...
উত্তরমুছুনচমৎকার একটি সহায়ক বৃত্তান্ত।
thank u vai.
উত্তরমুছুনখুবই সুন্দর লিখেছেন
উত্তরমুছুনthank u unknown vai.
উত্তরমুছুনআমি সত্যিই মুগ্ধ আপনার গাইড টি দেখে এত সুন্দর করে গুছিয়ে খুটিনাটি সহ আর কোন গাইড আমি পরিনি কখোনো। ধন্যবাদ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনshishir khan vai thank u.
উত্তরমুছুনশিমলা ও মানালি যে হোটেল এ ছিলেন তার নাম টা বললে খুশি হইটাম।
উত্তরমুছুনfacebook e knock korben kindly.
উত্তরমুছুনআমরা ৪/৫ জন মিলে চলতি বছরে মার্চ/এপ্রিলে ভ্রমণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছি! !! অনেক উপকারি একটা গাইড পেয়েছি আপনার লেখা থেকে!! ফেইসবুবে নক করলে একটু সাড়া দিবেন আশা করি!!!
উত্তরমুছুনOk
উত্তরমুছুনভাইয়া আপনার সম্পূর্ণ ট্যুরব্লগ টা পড়লাম খুব ভালো লাগলো... আমারো অনেক দিনের ইচ্ছা শিমলা আর মানালি যাওয়ার...কিন্তু কেউ কেউ বলেছে যদি সিকিম যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে সিমলা আর মানালি যাওয়ার দরকার নেই...আপনার মতামত দেবেন দয়া করে..অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনদুইটা প্লেসের ভিন্নতা আছে ।
মুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ।
উত্তরমুছুন