ষষ্ঠ পর্বঃ ট্রেক টু গুলমার্গ

গুলমার্গ, ফার্স্ট ফেজ

শ্রীনগর টু গুলমার্গঃ 

পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম সকাল আটটার দিকে । উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে হতে সাড়ে নয়টা বেজে গেলো । চারজন রুম বুক রেখেই হোটেল থেকে বেড়িয়ে গেলাম । কারণ রুমটি রেট হিসেবে ভালো ছিলো ।

শ্রীনগর থেকে Gulmarg ৫৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত । যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা । ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড নির্ধারিত ভাড়া হলো ২৪৮৬ রুপী । আমি গতদিনের সাথে মিলিয়ে হিসেব করলাম, ৮৩ কিলোমিটারের জন্য যদি ভাড়া দেই ২০০০ রুপী (ফিক্সড ৩৪০৫), তাহলে ৫৩ কিলোমিটারের জন্য ভাড়া আসে প্রায় ১৫০০ রুপী(ফিক্সড ২৪৮৬) । আমি এই হিসেবে গাড়ি ঠিক করার কথা ভাবছিলাম । দুই একটা গাড়ির সাথে কথা বলে পজিটিভ সাইনও পেয়েছি । এরমধ্যেই দেখি সূর্য ভাই ১৮০০ রুপীতে গাড়ি ঠিক করে নিয়ে এসেছে । ধুরু ! শুধু শুধু খরচ বাড়ালো এই লোকটা । আমাকে ডিল করার সুযোগই দিলো না। কি আর করার, অমনি গাড়িতে চেপে বসলাম । সকাল দশটার দিকে যাত্রা শুরু করলাম ।

প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভালো যে শ্রীনগর হলো কাশ্মীরের সেন্টার পয়েন্ট । আর বিভিন্ন ট্যুর স্পটগুলো সব শ্রীনগর থেকেই ভিন্ন ভিন্ন ডিরেকশনে চলে গেছে । এরমানে হলো আপনি যেখানেই যান না কেনো, শ্রীনগরের উপরে দিয়েই যেতে হবে ।

শ্রীনগর থেকে বিভিন্ন স্থানের অবস্থান 

আমাদের গাড়ি তাই এবার অন্য আরেক রুট দিয়ে চলা শুরু করলো । আমরা ড্রাইভার কে আগেই বলে দিয়েছিলাম যে একটা ভালো হোটেলের সামনে দাঁড়াতে, ব্রেকফাস্ট করবো । সেই হিসেবে উনি আমাদের একটা হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলেন । খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফের গাড়ি চলা শুরু করলো । বিশাল বিশাল মন মাতানো পাইন বাগানের বুক চিড়ে বয়ে চলা মসৃণ রাস্তা ধরে ছুটে চলছিলো আমাদের গাড়ি । কাশ্মীরে পথ চলার একটি জিনিস আমার খুব মজা লাগে । সেটা হলো - চলতে চলতে হঠাত দেখা যায় বিশাল এক পাল ভেড়া রাস্তা পার হচ্ছে । গাড়িগুলোও কোন হর্ণ না দিয়ে ভেড়াদের রাস্তা পার হওয়া অবধি অপেক্ষা করে । ভাল্লাগে জিনিস টা ।

ভেড়াদের রাস্তা পারাপার

বেলা বারোটা নাগাদ আমরা গুলমার্গ ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে গিয়ে পৌঁছাই । এখানে থেকে আবার সেই পনির রাইড নিয়ে যেতে হয় গুলমার্গ ফার্স্ট ফেজে । অনেক টাকা চায় । ৭০০-১৫০০ যার কাছে যেমন পায় । আমাদের পনিরে নেয়ার জন্য কয়েকজন কতভাবেই যে অনুনয় বিনয় করলো, বলার নাই কিছু । প্রায় আধাঘন্টা তারা আমাদের পিছু পিছু এসেছে । শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের কাছে সুবিধা করতে পারলো না ।

গণ্ডোলা রাইড সমাচারঃ

গণ্ডোলা রাইড হলো ক্যাবল কারে চড়ে স্থান পরিবর্তন । আমি গণ্ডোলা নামটা আগে কখনো শুনিনি, জানিনা এটি কাশ্মীরের নিজেদের দেয়া নাম নাকি পৃথিবীতে আরো কোথাও এই ক্যাবল কার ব্যবস্থাকে গণ্ডোলা বলে থাকে ! গুলমার্গের এই গণ্ডোলা রাইডটি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত ক্যাবল কার ব্যবস্থা । 

ফেজের ব্যাপার টা একটু ক্লিয়ার করি । গুলমার্গ ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড থেকে বরফের পাহাড়ের শুরুর অংশটা হলো ফার্স্ট ফেজ, জায়গাটার নাম Kungdoor । ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে, পনিরে বা গণ্ডোলায় চড়ে ফার্স্ট ফেজে যাওয়া যায় । আর সেকেণ্ড ফেজ হলো বরফের পাহাড়ের একেবারে উপরের অংশটা, জায়গাটার নাম Aparwath । ওখানে হেঁটে যাওয়াটা নরমালি পসিবল না, পনিরও যায় না । সেকেণ্ড ফেজে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো গণ্ডোলা রাইড ।  

গণ্ডোলা রাইড

গণ্ডোলা রাইডের ব্যাপারটা বাইরে থেকে দেখতে ব্যাপক লেগেছে আমার কাছে । যদি টাকাপয়সার সমস্যা না থাকতো, তাহলে হয়তো এক্সপেরিয়েন্স নিতাম । শখ থাকলেও সাধ্যের খাতিরে বাদ দিতে হয়েছে । রেট বেশ হাই । গুলমার্গ টু Kungdoor এর গণ্ডোলা ফি ৭৪০রুপী(রাইডিং ডিউরেশন ৯মিনিট), আর Kungdoor থেকে Aparwath এর ফি ৯৫০ রুপী(রাইডিং ডিরেশন ১২মিনিট) । এই ফি টা আপ-ডাউন মিলিয়ে ধরা হয়েছে । রেট বেশ হাই মনে হয়েছে আমার কাছে ।

 ট্রেক টু গুলমার্গঃ

যাহোক, আমরা হেঁটে হেঁটে পথ চলা শুরু করলাম । এখানেও সেই আগের কথাই । কোথাও কোন আর্টিকেলে পাইনি যেখানে বলা আছে Kungdoor এ হেঁটে যাওয়া যায় । সবাই ক্যাবল কার আর শিকারার কথা বলেছে । আমরা ওখানে এসব কিছুই নেইনি । সব হেঁটেই কাভার করেছি ।

গুলমার্গের পথে 

আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে, Kungdoor হেঁটে যাওয়া যায় । তবে হ্যাঁ এজন্য প্রচুর তেল খরচ করতে হবে শরীরের । অনেক লম্বা রাস্তা, আর বেশ খাড়া । সোনমার্গের রাস্তার মতো এতো ইজি ছিলো না গুলমার্গের রাস্তা । এজন্যই আমি এই পয়েন্টের নাম দিয়েছি - ট্রেক টু গুলমার্গ । ভালো কষ্ট হয়েছে । অনেক সময় লেগেছে Kungdoor  পৌঁছাতে । আমরা প্রায় ১২ টায় রওনা দিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা ট্রেকিং করার পরে তিনটার দিকে পৌঁছাই Kungdoor  এ । অবশ্য এই সময়টা যে পুরোটা শুধু হেঁটেছি, তা নয় নিশ্চয়ই । খেয়েছি, বিশ্রাম নিয়েছি, আড্ডা দিয়েছি । আমাদের এতো কিসের তাড়া দ্রুত পৌঁছানোর !

তবে এই যে কষ্টগুলো হয়েছে, কেনো যেনো এগুলো একটুও গায়ে লাগেনি সত্যি বলতে । একটা বাচ্চা ছেলে যেমন সারাদিন অনর্থক দৌঁড়াদৌঁড়ি করে, কোন ক্লান্তি নেই কিছুনা... আমারও সেরকম হয়েছে । ট্রেকিং এ গেলে শরীর ক্লান্ত হয়, বাট মন সদা উৎফুল্ল । শরীরের ক্লান্তির সাথে মনের ক্লান্তি যুক্ত হলে তাকে বলে স্ট্রেস । আমি ক্লান্ত হয়েছি, স্ট্রেসড হইনি কখনো । স্ট্রেসড হবো কিভাবে বলেন, এ যেনো সৌন্দর্যের সমুদ্র । আহা! নয়ন, মন ভরে যায় একদম । মানুষ স্ট্রেসড হয় বিরক্তি থেকে, মুগ্ধতা থেকে নয় । প্রেমিকার হাত ধরে দিনভর কড়া রোদে হেঁটে যেতে কেউ স্ট্রেসড হয়না, স্ট্রেসড হয় সেই মানুষটাই যখন একলা ঘরে ফেরে ।

চলতি পথে বিশ্রামরত

চারিদিকে সুউচ্চ পাইন গাছের বন, সবুজ মাঠ, ফুলের গাছ । এসবের মাঝেই ছিলো আমাদের পথ । মুগ্ধতায় কেটেছে সারাটাদিন । যে মানুষ মুগ্ধ হুতে পারেনা, সে কখনো ভালোবাসতে পারেনা । আমি প্রচুর ভালোবাসতে পারি - বুঝতে পারলাম তাই ।

গুলমার্গে বয়ে চলা নদী

আমরা চারজন পথিক

লোকে টাকা দিয়ে ঘোড়ায় যায়, আমরা ফ্রি তে ছবি তুলি

পথচলা

আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর হাঁটতে পছন্দ করি । একলা মানুষ কানে ইয়ারফোন দিয়ে অনর্থক অনেক রাস্তা হেঁটেছি । আমার একটা বিশেষ ইচ্ছে, যে মেয়েটাকে বিয়ে করবো, তারও যেনো হাঁটতে ভালো লাগে । তাকে নিয়ে আমি এরকম কম খরচের ট্যুর দেবো । কিন্তু কম ট্যুর দেবো না - এটা নিশ্চিত ।

 তিনটার দিকে Kungdoor (ফার্স্ট ফেজ) পৌঁছাই । বিশাল বরফের পাহাড় । চারিদকি শুভ্র বরফ । মাথার উপরে রোদ, পায়ের নীচে বরফ আর হিমহিম শীত । বেশ মজার ব্যাপার । অনেক্ষণ ওদিকে হাঁটাহাঁটি করলাম। ভালোই লাগলো । এখানেও দেখলাম বরফে খেলাধুলা করার নানা সরঞ্জাম রাখা হয়েছে । অনেক দাম চায় সবগুলোর ।

ফার্স্ট ফেজ, গুলমার্গ

ফার্স্ট ফেজ, গুলমার্গ

হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ক্যাবল কারের কাছে । ওখানে গিয়ে ক্যাবল কারের ফাংশন দেখছিলাম । এটা জম্মু-কাশ্মীর সরকার আর ফ্রান্সের একটা কোম্পানীর মিলিত প্রজেক্ট ।  বেশ সুন্দর ব্যবস্থাপনা ওখানে ।

গণ্ডোলা 

ঘণ্টা দুইয়েক পরে বেলা পাঁচটার দিকে ব্যাক ওয়েতে হাঁটা শুরু করি । এবারে দেখার চেয়ে ফেরার তাড়াটাই বেশি ছিলো । তাই কখন গাড়ির কাছে যাবো, সেই ব্যাপার টাই বেশি মাথায় কাজ করছিলো । শুরুতে খাড়া পাহাড় বেয়ে শুধু উঠেছি, তাও খারাপ লাগেনি । এবার নামার পালা, তাও মনে হচ্ছিলো গন্তব্য আর কতদূরে । একাধারে শুধু নীচের দিকে নেমেই গেছি, নেমেই গেছি । প্রায় দেড়ঘন্টা টানা হেঁটে সাড়ে ছয়টা নাগাদ গাড়ির কাছে পৌঁছাই ।

গাড়িতে চড়া মাত্রই একটানে শ্রীনগর এনে নামিয়ে দেয় । আটটার দিকে হোটেলের রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খানা খেতে বের হই । এরপরে পরবর্তী দিনের প্ল্যান । এই দুইটা দিন মহারাষ্ট্রের দুই ভাই এর সাথে বেশ ভালোই কেটেছে । তারা দুইজনেই জব করে । তাদের ছুটি শেষ । ফিরে যাবে নিজ গন্তব্যে । আগামীকাল বিকেলে তাদের ফ্লাইট । কিছুটা মুড অফ হয়ে গেলো এজন্য । ভালোই তো ঘুরছিলাম একসাথে, এখন দুইজন মিলে ঘোরাটাও সমস্যা হবে । আগামীকাল তবে কি করা যায় - আমি আর সুফল মিলেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম । সেই সিদ্ধান্তহীনতা থেকেই জন্ম নিলো - নষ্ট একটি দিনের গল্প ।

আজকের খরচঃ (০২/০৬/১৯)

১। ব্রেকফাস্ট = ১১৫/-

২।  গুলমার্গে দুপুরের খাবার = ১৩০/-

২। গাড়ি ভাড়া (২জন) = ৯০০/-

৩। খাওয়া = ১৬০/-

৪। হোটেল ভাড়া = ৪০০/-

মোটঃ ১৭০৫ রুপী 

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ 

<পূর্ববর্তী পর্ব   -  পরবর্তী পর্ব >