দশম পর্বঃ অপার্থিব পেহেলগাম
![]() |
| মিনি সুইজারল্যাণ্ড |
অপার্থিব পেহেলগামঃ(০৬/০৬/১৯)
কাশ্মীর ট্যুরের প্ল্যানিং এর শুরু থেকেই যে স্থানের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা শুনেছি সেটা ছিলো Pahalgam । আমাদের প্রচ্ছন্ন একটা ইচ্ছে ছিলো যে সিচুয়েশন মিলে গেলে পেহেলগামে একরাত থেকে যাবো । সেভাবেই কথা বলে আমাদের হোটেল থেকে বের হয়েছিলাম।
পেহেলগাম জায়গাটা লালচক থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । রিজার্ভ গাড়িতে যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টার মতো । পেহেলগামে ইন মেজর তিনটা স্পট সবচেয়ে বেশি পরিচিত । মিনি সুইজারল্যাণ্ড খ্যাত বাইসারান, আরু ভ্যালি এবং বেতাব ভ্যালি । রিজার্ভ গাড়ি নিয়েও একদিনে এই তিনটা স্পট ঘোরা কিছুটা টাফ । আবার দুইদিনে ঘোরাটা বেশি ঢিলেঢালা হয় । তবে সৌন্দর্যের বিচারে এবং হাতে সময় থাকা সাপেক্ষে অনেকেই এখানে এক রাত স্টে করাকে খুব সুন্দর একটি সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন ।
এছাড়াও এই পেহেলগামে আরো কিছু সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে বলে ওখানে যাবার পরে আমরা জানতে পেরেছি । যেমনঃ কাশ্মীর ভ্যালি, ডালিয়ান, ডেনো ভ্যালি, ওয়াটারফল, টুলিয়ান লেক, পেহেলগাম ভ্যালি, কানমার্গ ইত্যাদি । ইন্টারন্যাশনালি এসব প্লেস নিয়ে ততোটা জানাশোনা নেই মানুষজনের । সেসব জায়গায় যেতে চাইলে অতিরিক্ত সময়, অর্থ এবং প্ল্যানিং প্রয়োজন । তবে নরমালি মানুষজন উপর্যুক্ত মেজর তিনটি জায়গা ঘুরেই চলে আসে।
![]() |
| পেহেলগামের দর্শনীয় স্থান |
পেহেলগাম লোকালি যাওয়া খুব ইজি । ডালগেট থেকে ইসলামাবাদ, এরপরে সেখানে থেকে পেহেলগাম । দুইবার গাড়ি চেঞ্জ করেই যাওয়া যায় । যাহোক, আমরা দুধপত্রী লোকালি যাবার দিন যেসব ভুল করেছিলাম, আজকে সেসব এভয়েড করার চেষ্টা করলাম । হোটেল থেকে বের হলাম সকালে ৭ টায় । আমরা জানতাম ইসলামাবাদের ট্যাক্সি পাওয়া যায় ডালগেট থেকে । তবুও দুধপত্রীর ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য হোটেল থেকে বেড়িয়েই অটো নিলাম । অটোওয়ালার সাথে কন্ট্যাক্ট হলো ইসলামাবাদের ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে নামিয়ে দিতে হবে । অল্প একটু রাস্তার জন্য ৫০ রুপী দিলাম তাকে । তবুও পেইন নিতে চাচ্ছিলাম না ।
দুইজন ইসলামাবাদের ট্যাক্সিতে বসলাম । ডালগেট টু ইসলামাবাদ জনপ্রতি ১০০ রুপী ভাড়া । ঘণ্টা দেড়েক বাদে আমাদের ইসলামাবাদে নামিয়ে দিলো । সেখানে থেকে নির্বিঘ্নেই পেয়ে গেলাম পেহেলগামের ট্যাক্সি । ইসলামাবাদ টু পেহেলগাম ভাড়া গেলো জনপ্রতি ৮০ রুপী । ঘণ্টাখানেক বাদেই নামিয়ে দিলো পেহেলগামে ।
পেহেলগামের রাস্তার পাশে দিয়ে বয়ে চলেছে বিখ্যাত স্রোতস্বিনী লিদার নদী(Lidder River). এই সেই নদী ! কত বইতে, গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় এই নামটা শুনেছি... কত ফ্যান্টাসি ছিলো লিদার নামটা ঘিরে । "লিদার নদী" নামটা মনে এলেই অনন্য একটা ফিল কাজ করে । এতোদিন যার গল্প শুনেছি আজ সেটা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো । ট্রাভেলিং এর এটাই তো মজা । কল্পনায় বয়ে বেড়ানো জায়গাগুলো বা নামগুলো যখন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়, সেটা হয় অনন্য একটি মুহূর্ত ।
![]() |
| লিদার নদী |
পেহেলগাম পৌঁছেই দুইজন ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম । এরপরে কনফিউজড হয়ে গেলাম । এখন কি করবো ! পেহেলগামের যে জায়গায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয় সেখানে থেকে আরু ভ্যালি(Aru valley), চন্দনওয়ারি(chandanwadi), বেতাব ভ্যালি(Betaab Valley) আর বাইসারান(Baisaran) চারটি গন্তব্য তিনদিকে চলে গেছে ।
| গুগল ম্যাপে পেহেলগামের দর্শনীয় স্থানসমূহ |
পেহেলগাম থেকে বাইসারান যেতে হয় ট্রেকিং করে । কিন্তু পেহেলগাম থেকে যথাক্রমে ১২ এবং ৭ কিলোমিটার দূরবর্তী আরুভ্যালি এবং বেতাব ভ্যালিতে যেতে হয় ট্যাক্সি নিয়ে । বেতাব ভ্যালি থেকে চন্দনওয়ারি আরো ৮ কিলোমিটার দূরে । আরু ভ্যালিতে লোকাল ট্যাক্সি গেলেও বেতাব ভ্যালি বা চন্দনওয়ারির জন্য ট্যাক্সি রিজার্ভ নিতে হয় । দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম । কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করলাম। পাছে সুফল বললো পরের টা পরে দেখা যাবে, চল আগে আমরা বাইসারান ঘুরে আসি । প্রসঙ্গত, এই তিনটির মধ্যে মিনি সুইজারল্যাণ্ড খ্যাত বাইসারান সবচেয়ে বেশি সুন্দর বলে সবসময় জেনে এসেছি । তাই আগে এখানেই যাবো বলে মনস্থির করলাম । ওখানে থেকে ঘুরে এসে সিচুয়েশন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো ।
এখানে আরেক সমস্যা শুরু হলো । সোনমার্গ বা গুলমার্গের মতো পেহেলগাম থেকেও সাধারণত ট্যুরিস্টরা পনির রাইডের মাধ্যমে বাইসারনে যায় । সুতরাং সেসব ঘোড়াওয়ালারা আমাদের একপ্রকার চেপে ধরলো তাদের পনির রাইড নেয়ার জন্য । অনেক অনুনয় করেও কোনভাবেই আর আমাদের দুইজনকে রাজি করাতে পারলো না।
বাইসারানের পথেঃ
বলে রাখি, এই পথটাও পায়ে হাঁটা সহজ ছিলো না । খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়েছে অনেক সময় ধরে । তবুও ঘোড়া নেইনি । বাজেটের দিকে নজর দিতে হয়েছে । ঘোড়া নিলেই মিনিমাম জনপ্রতি ৫-৭০০ রুপী লাগতো । অনেক কষ্ট হয়েছে সেসব পাহাড় বেয়ে উঠতে সত্যি বলতে । তবুও এভাবেই চলেছি । যাত্রা পথ বরাবরেই মতোই খুবই সুন্দর ছিলো । সুবিশাল সব পাইন বনের মধ্যে দিয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে একেবেকে চলে গেছে পথ ।
![]() |
| বাইসারানের পথে |
![]() |
| বাইসারানের পথে |
![]() | |
|
চলতি পথে স্থানীয় এক মুরুব্বির সাথে দেখা । উনিই আমাদের গাইডের ভূমিকায় গল্প করতে করতে নিয়ে চললেন বাইসারানের দিকে । টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো । অমনি চলছিলো আমাদের পথচলা । সত্যি বলতে সৌন্দর্যের পিপাসায় পরিশ্রমের ক্লান্তিটা গায়ে লাগছিলো না সেভাবে । ঠিক মনে নেই, তবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে বেলা একটার দিকে আমরা পৌঁছাই বাইসারানে । জনপ্রতি ৩০ রুপী এন্ট্রি ফি দিয়ে ঢুকে পড়ি বাইসারানের ভেতরে ।
অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা এই বাইসারান ভ্যালি । একদম সবুজ সজীবতায় ভরপুর । ছবির মতো সুন্দর একটি জায়গা । এটাকে বলা হয় দ্য মিনি সুইজারল্যাণ্ড(The Mini Switzerland). খুবই ভালো লেগেছে ওখানে গিয়ে ।
![]() |
| বাইসারান |
![]() |
| বাইসারান |
![]() |
| বাইসারান |
ঘণ্টা দেড়েক ছিলাম ওখানে । সুন্দর কিছু সময় কেটেছে । কি সুন্দর পরিবেশ । মনে হচ্ছিলো সুবিশাল এরিয়া জুড়ে প্রকৃতি নিজের হাতে সবুজের গালিচা বিছিয়ে পর্যটকদের নিজ ভাষাতে অভিনন্দন জানাচ্ছে ।
প্রায় একটার দিকে ব্যাক ওয়েতে হাঁটা শুরু করলাম । একইপথে ব্যাক করা শুরু করলাম । অনেক্ষণ গুঁড়ি বৃষ্টিতে অনেকটাই ভিজে গেলাম । তার উপরে পিচ্ছিল পথে একবার পড়ে গিয়ে আমার পোশাক অনেকটাই কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে । তবে ব্যাক করা অনেকটাই ইজি ছিলো । কারণ এখন শুধু পাহাড় বেয়ে নামার পালা । প্রায় তিনটার দিকে পেহেলগামে পৌঁছে গেলাম ।
দুইজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম পেহেলগামে আজকে আর থাকবো না । কেনো যেনো বেতাব বা আরু ভ্যালীতে যাবার জন্য খুব একটা আগ্রহও খুঁজে পাচ্ছিলাম না । সমস্যা হলো অন্য জায়গায় ।
কাশ্মীর অনেক সুন্দর একটি জায়গা, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিটি স্পটের মধ্যে সৌন্দর্যের একটা ভালো রকম মিল আছে। সিম্পলি ব্যাপার টা এমন যে প্রতিটি জায়গাতেই আপনি পাবেন দৃষ্টিনন্দন পাইন গাছের বন, অসম্ভব সুন্দর সবুজ মাঠ, মন মাতানো স্রোতস্বিনী নদী আর শুভ্র বরফের পাহাড়। যারা কাশ্মীর ঘুরেছে অলরেডি, তারা পর্যন্ত পিক দেখে গুলমার্গ ,সোনমার্গ বা পেহেলগামের কিছু পয়েন্ট আলাদা করতে পারবে না। বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেই নেট ঘেঁটে দেখুন, দেখবেন সব একই মনে হয়। এসব এজন্যই বলছি যে শুধু শুধু এই ট্রিপ টা দীর্ঘায়িত করার দরকার নেই। অল্প দিন থাকলে একটা আলাদা ভালোলাগা নিয়ে ফিরতে পারবেন। বেশিদিন থাকলে একটা বোরিংনেস আসতে পারে।
সুতরাং বেতাব আর আরু ভ্যালির প্রতি জন্য এক্সট্রা কোন ফিল পেলাম না আর সত্যি বলতে । পেহেলগাম থেকে ফেরার পথ ধরলাম । প্রথমে ইসলামাবাদ এলাম । ততক্ষণে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে । ইসলামাবাদ থেকে পেহেলগামের ট্যাক্সি ভাড়া জনপ্রতি এখন রেগুলারের তুলনায় ডাবল করে চাইছে । কারণ সন্ধ্যা হয়ে যাবে, ফেরার পথে আর যাত্রী মিলবে না। বাধ্য হয়েই উঠে গেলাম । সন্ধ্যার পরে এসে ডালগেটে নামলাম । এসে খাওয়া-দাওয়া করলাম ।
আগামীকাল আমরা তাহলে লেহ অভিমুখে যাত্রা শুরু করবো । কিন্তু শ্রীনগর থেকে লেহগামী বাস সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন ছিলো । সুফল আমাকে TRC তে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি শুরু করলো । কিন্তু আমার ভালো লাগছিলো না যেতে । ওকে একাই পাঠিয়ে দিয়ে আমি চলে এলাম হোটেলে । গিয়ে ফ্রেশ হলাম । আরো কিছুক্ষণ পরে সুফল ফিরে এলো লেহ-এর বাসের খবর নিয়ে । সকাল সাতটায় শ্রীনগর TRC থেকে বাস ছাড়বে । আমাদের যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে । এই হলো আপডেট । এবং আমাদের এই ট্যুরের মূল ট্যুইস্ট শুরু হবে আগামীকাল থেকে ।
এই ছিলো আমাদের ছয়দিনের কাশ্মীর ট্যুরের আদ্যোপান্ত । আমি হিসেব করে দেখলাম আমরা যদি ঢাকা থেকে এসে শুধু ৬ দিন কাশ্মীর ভ্রমণ করে ঢাকায় ফিরে যেতাম এবং ঢাকা থেকে কাশ্মীর আসতে যে খরচ+সময় লেগেছে সেই একই খরচ+সময় যদি কাশ্মীর থেকে ঢাকায় যেতে এড করতাম, তাহলে আপডাউন ৬ দিন এবং কাশ্মীরের ৬ দিন, মোট ১২ দিনে আমাদের জনপ্রতি খরচ হতো মাত্র ১৩০১৪ বাংলাদেশী মুদ্রা । আমি ভেবে রেখেছি আগামী পর্বে তাই শুধুমাত্র কাশ্মীর ভ্রমণেচ্ছুকদের জন্য ঢাকা-কাশ্মীর-ঢাকা রুটে ১২ দিনে ১৩,০০০ টাকায় কাশ্মীর ভ্রমণের একটা সারাংশ তুলে ধরবো । যাদের এতো বড় সিক্যুয়াল পড়ার ধৈর্য্য নেই, তারা শুধু একাদশ পর্ব টা পড়তে পারেন । আমাদের ট্যুরের নেক্সট গল্প "লাদাখের পথে" শুরু হবে একাদশ পর্ব থেকে ।
আজকের খরচঃ (০৬/০৬/১৯)
১। হোটেল - ডালগেটের ইসলামাবাদ ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ড = ৫০/-
২। ডালগেট - ইসলামাবাদ = ২০০/-
৩। ইসলামাবাদ - পেহেলগাম = ১৬০/-
৪। বাইসারান এন্ট্রি ফি = ৬০/-
৫। পেহেলগাম - ইসলামাবাদ = ১৬০/-
৬। ইসলামাবাদ - ডালগেট = ৪০০/-
৭। খাওয়া-দাওয়া = ৩৭০/-
৮। হোটেল ভাড়া = ৪২৫/-
মোটঃ ১৮২৫ রুপী









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন