মেঘালয় সফরনামাঃ ষষ্ঠ পর্ব (ঘরে ফেরা)

 

ক্রাংসুরি ওয়াটার ফলস

 ক্রাংসুরি ফলস (Krang Suri Falls,Meghalaya):(২০/০৮/১৮)

আজকের দিনের আমাদের একমাত্র প্ল্যান হলো বিরডো এবং ক্রাংসুরি ঝর্ণা দেখা । এরপরে ঘরে ফেরা । সেই হিসেবে সকাল বেলা হোটেল থেকে চেক আউট করে ধীরেস্থিরে চলে গেলাম ডাউকির ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে । তিনজন মিলে একটা কারে চেপে বসলাম । ভাড়া গেলো ৫০০ রুপী । সেটা আমাদের ডাউকি নামিয়ে দিলো ।

এরপর ট্যাক্সি ঠিক করতে গেলাম । উদ্দেশ্য বিরডো ফলস এবং ক্রাংসুরি ফলস দেখা । কিন্তু গাড়িওয়ালারা এই বিরডো ফলস টা ঠিক চিনছিলো না । ত্যানা প্যাঁচানো শুরু করছিলো । ব্রিডো, বিডো, ব্রাডো... কত নামেই পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলাম, ঝর্ণার পিকচার দেখালাম... তাও চিনলো না । সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম এই ঝর্ণা দেখবো না । আবার শুধু ক্রাংসুরির জন্য যে ট্যাক্সিভাড়া চায়, তা আমাদের তিনজন হিসেবে বেশি হয়ে যাচ্ছিলো । আমরা জানতাম ক্রাংসুরিতে লোকাল গাড়িতে করে যাওয়া যায় । তাই তিনজনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে লোকাল গাড়িতে যাবো এবং শুধুমাত্র ক্রাংসুরি ঝর্ণাটাই দেখবো আজকে । এসব ঢিলেমি করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেছে ততোক্ষণে । আমাদের হাতে আসলে সময় ছিলো তো তাই এমন ঢিলেমি আচরণ । যাদের সময় খুব কম থাকে তাদের জন্য আমার সাজেশন হলো আপনারা একটা সলিড প্ল্যান বানিয়ে নিয়ে যাবেন দেশে থেকে । প্ল্যান সলিড হলে কম সময়ে, কম ঝামেলায় এবং কম বাজেটে অনেক কিছু দেখতে পারবেন । সেই প্ল্যান টা ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখিয়ে যে কয়দিন থাকবেন, সেই কয়দিনের জন্য একটা ফুল ট্যাক্সি রিজার্ভ করবেন । সে আপনাকে ডেইলি সকালে পিক করে সন্ধ্যায় হোটেলে ড্রপ করবে এবং শেষদিন ডাউকি বর্ডারে এনে নামিয়ে দেবে । অনেক নির্ভেজাল এবং সুন্দর একটা ট্রিপ হবে এটি তখন । আপনার একমাত্র কাজ শুধু দেশে থেকে সুন্দর একটা প্ল্যান বানিয়ে নিয়ে যাওয়া । যা এই সিরিজ পড়েই আপনারা খুব সুন্দরভাবে বানাতে পারবেন হোপফুলি । 

মেঘালয়ের একটা মজার জিনিস খেয়াল করলাম । আমাদের দেশে কারে চড়ার সাথে যেমন একটা স্ট্যাণ্ডার্ড ইস্যু আছে, ওদের তা না । গোটা মেঘালয়ে খুব অল্প বাস চলে বোধহয় । সবাই দেখি কারে চলাচল করে । ডাউকি ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডে গিয়ে যখন আমরা ক্রাংসুরিগামী ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম তখন এই বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারলাম । সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এতে করে লোকালি যাতায়াত করে । একটা ভিন্নধর্মী এক্সপেরিয়েন্স হলো এবার । একটা ৪ সিটের কারে আমরা বসলাম মোট ৭ জন । সামনে তিনজন আর পিছনে চারজন (ড্রাইভার বাদে) । হা হা হা...  যদিও খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবুও খুব ইনজয় করছিলাম । 

যাহোক, ডাউকি থেকে গিয়ে আমলারেন নামক একটা স্থানে নামিয়ে দেয়া হলো আমাদের । ভাড়া গেলো জনপ্রতি ৫০ রুপী । সময় লাগলো অনেক । বেশ গরমও পড়ে গেছে ততোক্ষণে । মনে মনে স্নোনেংপেডেং এর শীতল রাতটাকে খুব মিস করছিলাম । যাহোক, আমলারেন থেকে আরেকটা ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম । সেটা আমাদের সরাসরি ক্রাংসুরি নামিয়ে দিলো । এখানে তিনজন মিলে ভাড়া গেলো ৫০ রুপী  । ক্রাংসুরিতে যেখানে ট্যাক্সি ড্রপ করে সেখানে থেকে ঝর্ণা বেশ খানিকটা দূরে । অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে তবেই ঝর্ণার কাছে যেতে হয় । ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পরে অবশেষে সেই ঝর্ণার দেখা মিললো । 

তখন প্রায় দুপুর একটার মতো বাজে । ঝর্ণার এন্ট্রি ফি গেলো জনপ্রতি ৪০ রুপী । ঝর্ণায় গোসল করতে চাইলে লাইফ জ্যাকেট ম্যাণ্ডেটরি । এজন্য জনপ্রতি গুণতে হলো ৩০ রুপী । সর্বমোট জনপ্রতি ৭০ রুপী পে করার পরে আমরা ক্রাংসুরির জলে নামার অনুমতি পেলাম । কিন্তু এ কি ! ইউটিউবে কেমন ক্রাংসুরি দেখলাম আর বাস্তবে কেমন দেখি ! বেশ মরা ঝর্ণা । মনটাই খারাপ হয়ে গেলো । ডান্থলেনের রিপিট হলো ক্রাংসুরিতে এসে । ধুরু ! 

মন খারাপ করেই পানিতে নামলাম । পানিতে নামার সাথে সাথেই যেনো চোখের  পলকে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো । হঠাত করেই যেনো ছোট মানুষ হয়ে গেলাম তিন বন্ধু । চোখের পলকেই রুক্ষ তপ্ত দিনটা যেনো বসন্তের কোমলতা নিয়ে আমাদের ছুঁয়ে দিতে লাগলো ! আনন্দের আতিশায্যে মনে মনে গুঞ্জরিত হচ্ছিলো -

 "আহা আজি এ বসন্তে, এতো ফুল ফোটে 
 এতো বাঁশি বাজে, এতো পাখি গায় !" 

ঝর্ণার পানি পতনের শব্দ আমার কানে তখন ফুল, পাখি আর বাঁশি হয়ে গলে পড়ছিলো যেনো । উফ বেঁচে থাকাটাই কি ভীষণ আনন্দের ! সাঁতারু ও জলকন্যা বইতে পড়া শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথাটা মনে পড়ে গেলো । 

"শুধু বেঁচে থাকতে পারলে, কোনওরকমে কেবলমাত্র বেঁচে থাকতে পারলেও জীবনে কত কি যে হয় !" 

কি সুন্দর একটা কথা তাইনা ? আসলেই তো কেবল বেঁচে থাকতে পারলেই কত কিছু হয় ! মায়ের হাতের রান্না খাওয়া যায়, "ভালোবাসি বাবা" এই কথাটা না বলতে পারার জন্য আফসোস করা যায়, প্রকৃতি দেখতে দেখতে এক মগ কফি খাওয়া যায়, সামনের মাসে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করা যায়, নিজের সন্তানগুলোকে দেখতে পাওয়া যায়, প্রেয়সীর নূপুরের শব্দ আর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের মধ্যে কোনটা বেশি শ্রুতিমধুর সেই পার্থক্য করার সুযোগ পাওয়া যায়... এমনকি বেঁচে থাকলে ক্রাংসুরিতে গোসলও করা যায় ।

শেষদিনের এই একটা গন্তব্য আমাদের এই ট্রিপটাকে সম্পূর্ণতা এনে দিলো, বারবার এমনটা মনে হচ্ছিলো শুধু । প্রায় দুই ঘণ্টা টানা গোসল করেছিলাম সেখানে । এই দুই ঘণ্টা যেনো চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেলো । ক্রাংসুরিতে নেমে নেপালি দুইটা মেয়ের সাথে পরিচয় হলো । শুধুমাত্র এরা দুইজনই একসাথে নেপাল থেকে ঘুরতে এসেছে মেঘালয়ে । মেয়েরা এখন আগের চেয়ে কত এডভান্স, কত ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট তাইনা ? 

ট্রাভেলিং নিয়ে লেখালেখি করার কারণে প্রায়ই আমি একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই । অনেক মেয়েই প্রশ্ন করে, ভাইয়া আমরা দুইটা মেয়ে ঘুরতে যাবো, কোন সমস্যা হবে না তো ? এর আসলে এক কথায় কোন উত্তর নেই । সমস্যা সবসময় লিঙ্গ দেখে হয়, এমনটা না । সে যে লিঙ্গেরই হোক না কেনো, সমস্যা হয় স্মার্টনেসের অভাবে । কুল ডুড টাইপ বিষয়টা আসলে স্মার্টনেস না । স্মার্টনেস জিনিস টা আসলে বুদ্ধি এবং চিন্তার সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত । আপনি যদি আপনার সিচুয়েশন স্মার্টলি হ্যাণ্ডেল করতে পারেন, তাহলে আশা করা যায় কোন সমস্যায় পড়বেন না । কেবল মেয়ে বলেই সুযোগ নেয়ার যে ইনটেনশন আমাদের মাঝে রয়েছে, এই প্রবণতা টা বাইরের দেশে অনেক কম বা ক্ষেত্রবিশেষে নেই বললেই চলে । ভারতে আমি যেসব জায়গায় ঘুরেছি; স্পেশালি লাদাখ-কাশ্মীর-সিমলা-মানালি আর এই মেঘালয়, এসব জায়গায় মানুষজনের আচরণ হাইলি স্যাটিফফাইং লেভেলের ছিলো । এমনকি বেঙ্গালোরের একটা বাস ড্রাইভারের মধ্যে যে এটিকেট সেন্স আমি পেয়েছি, তা আলাদা করে বলার মতো ছিলো । ইন্ডিয়ার যত ফাউল মানুষজন, সম্ভবত সব জড়ো হয়েছে গিয়ে দিল্লি আর কলকাতায় । শুনেছি মুম্বাইও এদের জাত ভাই । কোন এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সেখানকার মানুষের আচরণগত সম্পর্ক আছে বোধহয়। তা না হলে কেবল সুন্দর জায়গার মানুষের আচরণ ম্যাক্সিমাম টাইমেই সুন্দর হয় কেনো ? 

নেপালি মেয়ে দুইটার সাথে কাওছার এবং সুফল

আমরা তিন বন্ধু

ক্রাংসুরি ঝর্ণা

যাহোক, ঝর্ণায় গোসল করতে করতেই অনেক আড্ডা হলো নেপালী মেয়ে দুইটার সাথে । মেয়ে দুইটা সাঁতার পারে না । দেখি সুফল ওদের সাঁতার শিখাচ্ছে । যেখানে সুফল নিজেই বান্দরবানে হাঁটু পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে পানি খেয়ে একাকার অবস্থা... সেখানে সে শিখাচ্ছে সাঁতার ! সুফল ছোট থেকে ঢাকায় বড় হয়েছে । সাঁতার শিখার জন্য সুইমিং পুলে গিয়ে কোর্স করতে হয়েছে ওকে ।  সেখানে থেকে সুইমিং এর উপরে একটা সার্টিফিকেটও পেয়েছে । আমাদের মাঝে একমাত্র বন্ধু সে যার সুইমিং এর সার্টিফিকেট আছে । কিন্তু সাঁতারে একদম আনাড়ি বলে ওরে আমরা "সার্টিফিকেটধারী সাঁতারু" বলে ক্ষেপাই মাঝেমাঝে । আজকে সেই সার্টিফিকেটধারী সাঁতারু বন্ধু কর্তৃক নেপালী মেয়ে দুইটাকে সাঁতারে তালিম দেয়া দেখে আমি আর হাসি থামাতে পারলাম না । 

একটা বিষয় এড করি । আমরা ঘুরে আসার পরের বছর আমার কয়েকটা জুনিয়র বেড়াতে গিয়েছিলো ক্রাংসুরিতে । ইউটিউবে যেমন মাতাল করা ক্রাংসুরি দেখেছিলাম, ওরা সেই ভিউটা পেয়েছিলো । শুনে আফসোস লাগছিলো । পরে যখন জানতে পারলাম যে ঝর্ণা ওভার ফ্লো হলে সেখানে গোসল করতে দেয়না, তখন সাথে সাথে এই ঝর্ণা দেখে শুরুতে যে আফসোস টা হয়েছিলো তা তিরোহিত হয়ে গেলো । মেঘালয় ট্রিপে গিয়ে ঝর্ণা তো অনেক দেখলাম, কিন্তু বেশিরভাগ ঝর্ণাতেই গোসল করা যায় না । তাই ওদের কাছে ক্রাংসুরির গল্প শুনে মনে হচ্ছিলো ওরা ক্রাংসুরিতে গোসলের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে । এটা অনেক বড় একটা মিস । বিষয়টা কেমন হয়ে গেলো না ? প্রতিটি অপ্রাপ্তির পেছনে একটা করে প্রাপ্তি জড়িয়ে থাকে । আমরা ভিউ পাইনি বলে গোসলের সুযোগ পেয়েছিলাম। ওরা ভিউ পেয়েছিলো বলে গোসলের সুযোগ মিস করেছে । 

যাহোক, আর কত গোসল করা যায় ! এদিকে বর্ডার ক্রস করার ঝামেলা রয়েছে । দেরি হয়ে গেলে বর্ডার ক্লোজ হয়ে যাবে । তাই গোসল শেষ করতে হলো । গোসল শেষ করে যখনই ফিটফাট হলাম, তখনি আবার বৃষ্টি শুরু হলো । ঝর্ণার পাশে একটা জায়গায় শেল্টার নিলাম তিনজনে । বৃষ্টি আমাকে যতই বিড়ম্বনা দিক না কেনো, কখনোই কেনো যেনো বিরক্ত লাগে না । আমার জন্মের সাথে বৃষ্টির একটা দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। হয়তো এটাই কারণ ! আমি যেদিন জন্ম নেই তখনও নাকি কয়েকদিন ধরে মুষলধারে এমন টানা বৃষ্টি হচ্ছিলো । এরপরে আমি পৃথিবীতে এলাম । আব্বু শখ করে আমার নাম রাখলেন "রেইন" । ব্যস আমার নাম হয়ে গেলো রেইন আর আমার সখ্যতা হয়ে গেলো বৃষ্টির সাথে । এই বৃষ্টি কিন্তু কোন মেয়ে না, এটা প্রকৃতির বৃষ্টি । প্রসঙ্গত, ছোটবেলায় বৃষ্টি নামের কোন মেয়ের সাথে কখনো পরিচয় হয়েছে এবং তাকে জড়িয়ে আমাকে ক্ষেপানো হয়নি, এমনটা বিরল ছিলো । এই নামেই আমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু সমাজ তথা নিজ এলাকা এবং আত্মীয়দের মাঝে পরিচিত । ফাহিম নামে পরিচিত হওয়া শুরু করলাম ক্লাস নাইন থেকে । 

ঘরে ফেরাঃ 

যাহোক বৃষ্টি একটু কমে এলে আমরা হাঁটা শুরু করলাম ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডের দিকে । আবার ২০ মিনিটের মতো হাঁটতে হলো । কিন্তু আমলারেনগামী কোন ট্যাক্সি পেলাম না । অপেক্ষা না করে তিন বন্ধু হাঁটা শুরু করলাম । টিপটিপ বৃষ্টিতে আশেপাশের প্রকৃতি বেশ সুন্দর লাগছিলো । সুতরাং ক্লান্ত শরীরেও হাঁটতে খারাপ লাগছিলো না । বেশিক্ষণ হাঁটা লাগেনি যদিও । একটু পরেই একটা ট্যাক্সি পেলাম । সে আমাদের নামিয়ে দিলো আমলারেনে । এখানে জনপ্রতি ভাড়া গেলো ১০ রুপী । এরপরে সেখানে থেকে আরেকটা ট্যাক্সিতে চড়ে চলে গেলাম ডাউকিতে । ডাউকি থেকে হেঁটে  আমরা বর্ডারে চলে গেলাম ।

তখন ঘড়িতে পাঁচটার মতো বাজে হয়তো । ইমিগ্রেশন অফিসারদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম বর্ডার নাকি প্রায় ৬টা অবধি খোলা থাকে । যাহোক, আমরা গিয়ে দেখি কোন ভীড় নেই । নির্বিঘ্নে দুই দেশের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করলাম খুব সামান্য সময়ের মাঝেই । একটা কথা স্পষ্টভাবে জেনে রাখুন । আপনারা যেদিন ভারতে প্রবেশ করবেন সেদিন খুব ভালো ভাবে ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে থেকে জেনে নেবেন যে বর্ডার কয়টায় ক্লোজ হয় । কারণ ব্যাক করার দিন সবারই কোন না কোন প্ল্যান থাকে । সেই প্ল্যানটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্যই এই বিষয়টা জানা প্রয়োজন । 

যাহোক, নিজ দেশে পা দিয়েই হালকা লাগছিলো । দেরি না করে বাস ধরে চলে গেলাম সিলেটে । সিলেটে গিয়েই আগে ভালোমতো খাওয়াদাওয়া করে নিলাম । এরপরে তিনজনের মধ্যে ক্যাচাল শুরু হলো । ক্যাচালের বিষয়বস্তু হলো ঢাকা যাবো কিভাবে... বাসে নাকি ট্রেনে । অবশেষে আমরা তিনজন দুইভাগে ভাগ হয়ে গেলাম । সুফল একা বাসে গেলো । আমি আর কাওসার ট্রেনে গেলাম । সিট পাওয়া যাক বা না, অন্তত টাইমলি বাড়ি পৌঁছাতে তো পারবো । কালদিন পরে ঈদে । বাই রোডে জ্যামের কোন নিশ্চয়তা নেই । আমার নিজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও শুনেছি ঈদের পূর্বে ঢাকা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী সিরাজগঞ্জ যেতে ক্ষেত্রবিশেষে ১০-২০ ঘণ্টাও লাগে অনেক সময় । শেষমেশ রাস্তাতে ঈদ করা লাগলে জিনিস টা খারাপ লাগবে । তাই সবমিলিয়ে ট্রেন প্রিফার করা । শরীরের উপর দিয়ে এই ছয়দিন যে ধকল গেছে এখন গরমের মাঝে ধীরে ধীরে তা টের পাচ্ছিলাম । যাহোক, টিকিট না কেটে প্রায় দৌঁড়ে গিয়ে ঢাকাগামী রাতের ট্রেনটা ধরলাম । টিটি এলে দুইজন মিলে ৪০০ টাকা দিলাম । এতো টাকা বোধহয় কেউ দেয়না । কারণ দেখলাম টিটি খুব খুশি হয়ে আমাদের একটা কার্টুনের উপরে বসতে দিলো ।  আমরা সারা রাস্তা বসেই চলে এলাম ঢাকায় । যেহেতু প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করার ঝামেলা নেই, সুতরাং গেটে টিকিট চেকিং ইস্যু নিয়ে কোন প্যারাও নেই। 

কমলাপুর কয়টায় নেমেছিলাম মনে নেই । নেমেই দুই বন্ধু সিরাজগঞ্জের ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম । সিলেট টু ঢাকা ট্রেনে তেমন ভীড় না থাকলেও ঢাকা - সিরাজগঞ্জ ট্রেন একদম ফুললি লোডেড ছিলো । ঈদের আগেরদিন ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন যেমন হবার কথা, তেমনি ছিলো । সে এক দুর্ধর্ষ জার্নি ছিলো । কোন ট্রেনে উঠেছিলাম, সিরাজগঞ্জ কয়টায় নেমেছিলাম কিছুই মনে নেই । শুধু মনে আছে খুব কষ্ট হয়েছিলো এই ট্রেন জার্নিতে । এতো ভীড়ে টিটিও আসতে পারেনি । তাই সিরাজগঞ্জ অবধি যেতে আমাদের কোন টাকাও লাগেনি । আর এভাবেই আমাদের এই মেঘালয় ট্রিপ টা শেষ হলো । আর আমরাও পরিবারের সাথে ঈদ পালন করতে পেরেছিলাম । 


আজকের খরচঃ(২০/০৮/১৮)

১। শিলং - ডাউকি = ১৭০/-
২। ডাউকি - আমলারেন = ৫০/- 
৩। আমলারেন - ক্রাংসুরি = ১৭/- 
৪। ক্রাংসুরি এন্ট্রি ফি = ৪০/- 
৫। লাইফ জ্যাকেট ভাড়া = ৩০/- 
৬। ক্রাংসুরি - আমলারেন = ১০/- 
৭। আমলারেন - ডাউকি = ৫০/- 
৮। খাবার খরচ = ৬২/- 
............................................................
মোটঃ  ৪২৯রুপী (জনপ্রতি) 



রুপীর হিসাবঃ 

(১৫/০৮/১৮) =  ৭৫০ রুপী 
(১৬/০৮/১৮) =  ১১২৭ রুপী 
(১৭/০৮/১৮) = ১০২৭ রুপী 
(১৮/০৮/১৮) = ১০১০ রুপী 
(১৯/০৮/১৮) = ১৬১৬ রুপী 
(২০/০৮/১৮) =  ৪২৯ রুপী 
...................................................
মোট খরচ = ৫৯৫৯ রুপী (জনপ্রতি) 

আমরা ডুয়েল কারেন্সি কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথে থেকে রুপী তুলেছিলাম। আপনারা হয়তো জানেন যে এভাবে ভিনদেশে গিয়ে কারেন্সি তুলতে হলে প্রতি ট্রাঞ্জেকশনে ২-৩ ডলার এক্সট্রা কেটে নেয় । আবার ৫০০রুপীর কম এমাউন্ট থাকলে সেটা তোলাও যায় না । সুতরাং সব মিলিয়ে ডলার রেট কত পেলাম সেই ক্যালকুলেশন টা আর একদম টু দ্যা পয়েন্টে করা হয়নি । তবে আমরা যখন যাই তখন দোকানগুলোতে এভারেজ রেট ছিলো ১০০রুপীতে ৮০ টাকা । আমি এই ভ্যালুটা ধরেই রুপীগুলোকে টাকায় কনভার্ট করে হিসাবটা তুলে ধরলাম ।  

৮০ রুপী = ১০০ টাকা হলে, 
৫৯৫৯ রুপী = ৭৪৪৯ টাকা । 



টাকার হিসাবঃ

১৫/০৮/১৮ 
১। ব্রেকফাস্ট = ৬২ /- 
২। সিলেট - তামাবিল = ৬০/- 
৩। ইমিগ্রেশনে স্পিড মানি = ১০০/- 
৪। ট্রাভেল ট্যাক্স = ৫০০/- 
৫। ঢাকা - সিলেট  = ৩২০/- 

২০/০৮/১৮
১। তামাবিল - সিলেট = ৬০/- 
২। রাতের খাবার = ১১৯/- 
৩। সিলেট - ঢাকা = ২০০/- 
.........................................................
দুই দিনে মোটঃ ১৪২১ টাকা (জনপ্রতি) 

সুতরাং ট্রাভেল ট্যাক্স সহ ৬ দিনের ঢাকা-মেঘালয়-ঢাকা ট্রিপে আমাদের জনপ্রতি খরচ হলো (১৪২১+৭৪৪৯)= ৮৮৭০ টাকা । 



কিছু কথাঃ 

১। ঘুরে আসার তিন বছর পরে লিখতে বসে সত্যিই বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো আমাকে । সেই হিসাবগুলো বের করা, সময়গুলো স্মরণ করা এবং গুগলে প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করে নতুন করে তথ্য উপাত্ত সাজানো... সবমিলিয়ে ভালোই কষ্ট হয়েছে লিখতে । তবে লিখতে বসে অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম যখন যে অংশ নিয়ে লিখছিলাম ঠিক তখন ট্যুরের সেই সময়টাকে যেনো খুব স্পষ্টভাবে ফিল করতে পারছিলাম । পুরো ট্রিপের মধ্যে একটা বিষয়ে শুধু হালকা কনফিউশন থেকে গেলো । আমার যতোদূর মনে পড়ে তামাবিল থেকে গিয়ে সিলেটে নামার পরে শহরের ম্যাক্সিমাম রাস্তা হেঁটেই চলাচল করেছিলাম । এখানে কোন সিএনজিতে উঠেছিলাম কিনা মনে পড়ছে না । সুতরাং সিলেটে নামার পরে আর কোন ছোট ট্রান্সপোর্টেশনের ভাড়া এড করা হয়নি । হিসাবের ব্যাপারে আমি যে পরিমাণ সচেতন এবং যে পরিমাণ আন্তরিকতা নিয়ে সিরিজটা লিখেছি যে বিশেষ কোন অসংগতি থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ । তবুও সিরিজে কোন ভুল থাকলে তার দায়ভার একান্তই আমার নিজের এবং সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী ।  

সবমিলিয়ে আমি আশাবাদী এই সিরিজটা পড়লে মেঘালয় নিয়ে একদম স্পষ্ট একটা আইডিয়া পেয়ে যাবেন । তবে একটা ট্রিপ কখনোই শতভাগ আরেকজনের সাথে মিলবে না । এমনকি নিজেরা মিলেও যতোই নিখুঁত প্ল্যানিং করেন না কেনো... কোথাও একটা ঝামেলা লেগেই যায় । সুতরাং সেভাবেই মেন্টালিটি সেট করে রাখবেন । আমাদের এই ট্রিপের আরো ফটো দেখতে চাইলে আমার ফেসবুকে পোস্ট করা Trip to Meghalaya এলবামটি দেখতে পারেন।

এছাড়া আমার আরো দুইটা ব্লগ সিরিজ রয়েছে । মেঘালয় ট্রিপের মাস পাঁচেক আগে গিয়েছিলাম সিমলা-মানালি ট্রিপে । ১২ দিনের সেই সফরে আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছিলো ১২,০০০ টাকার মতো । সেটা নিয়ে "কম খরচে সিমলা-মানালি সফর" শিরোনামে ৮ পর্বের একটা সিরিজ লিখেছি । 

২০১৯ সালে আরেকবার কাশ্মীর-লাদাখ(প্যাংগং) বেড়াতে গিয়েছিলাম । ১৯দিনের সেই ট্রিপে জনপ্রতি খরচ হয়েছিলো ২০,০০০টাকার মতো । সেটা নিয়েও "কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ" শিরোনামে ২০ পর্বের একটা সিরিজ লিখেছি । কম খরচে যারা এসব জায়গায় ঘুরতে আগ্রহী, হোপফুলি তাদের জন্য খুব উপকারী হবে সিরিজগুলো । 


২।আমাকে যদি বলা হতো তোমাকে শুধুমাত্র একটা গুণ দেয়া হবে । তুমি কি চাইবে । সম্ভবত আমি চাইতাম "বিনয়" । শিক্ষার সবচেয়ে প্রধান আউটপুট হলো বিনয় । যার মাঝে বিনয় নেই তার নিজেকে শিক্ষিত দাবী করার কোন অধিকার নেই । যদিও আমি খুব বেশি কিছু দেখিনি । তবুও নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যত দূরে গিয়েছি, দেখেছি মানুষ কত বিনয়ী হয় । জাতিগতভাবে আমাদের মাঝে এই মানবীয় গুণটার বড় বেশি অভাব । আমাদের যতো সার্টিফিকেট জমে, আমরা ততোটাই অহংকারী হয়ে উঠি । আমরা যেখানে ঘুরতে যাই, সেখানে গিয়েই সেই পরিচয় রেখে আসি । মনে রাখবেন বাইরের দেশে যখন ঘুরতে যাবেন তখন আপনি সেখানে গোটা বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি । আপনার আচরণের উপরে ভিত্তি করে সে ডিফাইন করবে গোটা বাংলাদেশকে । এটা অনেক বড় একটা রেসপন্সিবিলিটি । সেই হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপন করবেন ।
 আপনাদের যেকোন প্রয়োজনে আমাকে ফেসবুকে নক দিতে পারেন । আমাকে সবসময়ই পাশে পাবেন ইনশাআল্লাহ । বাট আপনার মধ্যে বিনয়ের অভাব থাকলে আমার কাছে কোন ফিডব্যাক আশা করবেন না অনুগ্রহ করে । 

৩। অবশ্যই বেড়াতে গেলে যত্রতত্র ময়লা ফেলবেন না । আমাদের ঢাকা শহর যতোটা নোংরা, এর চেয়ে নোংরা শহর পৃথিবীতে আর আছে কিনা আমি জানিনা । আমরা যেখানেই যাই সেখানে গিয়েই একটা ঢাকা শহর বানাতে চেষ্টা করি । এই কাজটা করবেন না প্লিজ । সবাইকে ভালো হতে হবে না, শুধু আপনি আর আমি ভালো হলেই চলবে । আপনি নিজের বাড়িও নোংরা করবেন না, বেড়াতে গিয়ে অতিথির বাড়িও না । 

৪। কম বাজেটে ট্রাভেলিং নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে মানুষজনের অনেক কটু কথা শুনতে হয় বিভিন্ন সময়ে । অনেকের ধারণা থাকে আমাদের আসলে খরচ অনেক হয়, কম খরচ দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা চেষ্টা করি মাত্র । আসলেই সেসব কিছু না । আমি যেসব জায়গায় যাই, সাধারণত আমার মতো গরীবেরা সেসব জায়গায় যায় না । সুতরাং সবার অনেক খরচ হলেও আমার হয় না । ঘুরতে গিয়ে খরচ কমানোর দুইটা স্বতঃসিদ্ধ শর্ত রয়েছে । প্রথমত, আপনাকে গরীব হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, আপনার ঘোরার ইচ্ছে থাকতে হবে ষোলআণা । এর একটা শর্তও যদি ফসকে যায়, তাহলে আপনি আর কম খরচে ঘুরতে পারবেন না । খরচ কমানোর জন্য অনেক বুদ্ধিবৃত্তি থাকা লাগে, সেরকম কিছুনা । 

৫। সবচেয়ে ননসেন্স মার্কা কমেন্ট যেটা পাই সেটা হলো "ভাই আপনার লেখা পড়ে এই টাকা নিয়ে ঘুরতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম।"  এগুলো হলো পিওর আবুল । ভাই আপনি একজনকে অন্ধভাবে ফলো করতে গেছেন কেনো ? আমি আপনাকে একটা ওভারভিউ দিলাম । বাকিটা আপনি আপনার মতো করে সাজাবেন । দ্যাটস ইট । আর আমি কি কোথাও বলেছি নাকি এই টাকায় এই ট্যুর না হলে সব দায়ভার আমার ! কাজও করেন বোকার মতো, কথাবার্তাও আজাইরা । আর কোথাও গেলে সেফটি মানি রাখা লাগে, এটা কি আপনাকে ডেকে নিয়ে কানে কানে বলতে হবে নাকি ?  

৬। "ভাই এতো কষ্ট করে ঘোরা যায় নাকি !" কিউট একটা কমেন্ট পাই মাঝেমাঝে । এই কমেন্টের রিপ্লাই হলো ভাই আপনার বস্তা ভরা টাকা থাকলে আপনি খরচ করেন । কোন সমস্যা নেই । কিন্তু আমি গরীব মানুষ, বাধ্য হয়ে আমাকে হিসেবী আচরণ করতে হয় । কেউ শখ করে কম খরচে ঘোরে না । আর আমি আপনার জন্যও লিখিনা । লিখি আমার লেভেলের ট্রাভেলারদের ইন্সপায়ার করার জন্য । 


৭। সামনে বর্ষার সিজন শুরু হবে । পৃথিবী সুস্থ থাকলে এই সময়ে মেঘালয় সফরের উৎসব শুরু হয়ে যেতো। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রাখুক । ইনশাআল্লাহ আজ না হোক... কোন একদিন অবশ্যই মেঘালয় যাবেন । আমাদের দেশের এতো কাছে এতো সুন্দর জায়গা রয়েছে যা না দেখলেই নয় । 
  
সবশেষে বলতে চাই... প্রচুর ট্রাভেলিং করুন । সাধ্য এবং সীমাবদ্ধতার সমন্বয় করে যতোটা সম্ভব প্রিয়জনদের নিয়ে ঘুরতে যান । গুণীজনরা বলে থাকেন ট্রাভেলিং করলে নাকি মানুষের মন বড় হয়, নিজের ক্ষুদ্রতা নিজের কাছে ধরা পড়ে, ট্রাভেলিং নাকি মানুষকে বিনয়ী হতে এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয় । 


শুভ কামনায়-  
ফাহিম কবির, 
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়,
ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ । 









মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

একাদশ পর্বঃ ১২,৮২৭ টাকায় ১২ দিনে ঢাকা থেকে কাশ্মীর ভ্রমণ (বিশেষ পর্ব)