চতুর্দশ পর্বঃ প্যাংগং লেক - ১

প্যাংগং এর পাড়ে আমরা দুই বন্ধু 

গন্তব্য প্যাংগং লেকঃ (০৯/০৬/১৯)

পরদিন একদম সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দুই বন্ধু চলে গেলাম লেহ বাসস্ট্যাণ্ডে ।  টিকিট কাউন্টার তখনো খোলেনি । দুই বন্ধু গিয়েই দেখি আর্জেন্টাইন এক কাপল বসে আছে সেখানে । কথায় কথায় জানতে পারলাম তারাও প্যাংগং লেক যাবে এবং বাসের জন্য অপেক্ষা করছে । কথাবার্তায় বেশ আন্তরিক মনে হলো । সেখানেই দেখলাম একটা ছোট হোটেল ছিলো । সেখানেই আমরা আমাদের ব্রেকফাস্ট সারলাম এবং কিছু এক্সট্রা খাবার কিনে নিলাম । 

লেহ বাসস্ট্যাণ্ডের বিপরীত দিকের ভিউ

ব্রেকফাস্ট সেরে এসে দেখি আরেকজন মেক্সিকান এসে হাজির । আর্জেন্টাইন দুইজন আর মেক্সিকান টা বসে গল্প করছে । আমরা দুইজন জয়েন করলাম তাদের গল্পে । আর্জেন্টাইন দুইজনের নাম মাতিয়াস আর জুলিয়েট, মেক্সিকান টার নাম ছিলো ইভান । বেশ আড্ডা দিলাম । এরপরে টিকিট কাউন্টার ওপেন হলে গিয়ে নিজেদের টিকিট সংগ্রহ করলাম । ভেবেছিলাম অনেক কম্পিটিটর থাকে হয়তোবা, পরে গেলে যদি টিকিট না পাই... কিন্তু বুঝলাম আসলেও সেরকম ভীড় নাই ।

টিকিট নিয়ে বাসে উঠে বসলাম । আজকের বাসটাও গতদিনের সেই শ্রীনগর-লেহ রুটের বাসের মতোই । বাসে উঠেই দেখি আরো কিছু বিদেশী নাগরিক বাসে বসে আছেন । আজকে যতদূর মনে পড়ে সেখানে উপস্থিতিদের মধ্যে ছিলো -
 ইংল্যাণ্ডের এক বৃদ্ধ দম্পতি, স্পেনের এক ভদ্রমহিলা, আর্জেন্টাইন কাপল, একজন মেক্সিকান, রাজস্থানের একটা মেয়ে, দক্ষিণ ভারতের দুই বন্ধু, ন্যাটিভ একজন মহিলা এবং দুইটা ছেলে...
আপাতত আর মনে পড়ছে না । সেই জার্নিতে সবার সাথে এতো আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিলো যে আজকে ৫ মাস পরে লিখতে বসেও মোটামুটি ২-৪ জন বাদে সবার কথাই মনে আছে । এমনকি ড্রাইভার আংকেলের সাথেও আমার বেশ সখ্যতা হয়ে গিয়েছিলো ।

বাসে উঠেই দেখলাম সবাই নিজ নিজ আসনে বসে আছে । আমরাও নিজেদের আসন গ্রহণ করলাম । সকাল সাতটার দিকে বাস মুভ করা শুরু করলো । বাস কিছুক্ষণ মোটামুটি সমতল ধরেই চললো । একটা সময় পরে গিয়ে খেয়াল করলাম বাস এখন পাহাড়ের গা বেয়ে চলা শুরু করেছে । কি রাস্তা রে ভাই । গতদিনের শ্রীনগর-লেহ রোডের চেয়েও এক্সট্রিম । মনে হয় গড়িয়ে পড়ার আশা নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে অসংখ্য বড় বড় পাথর তাকিয়ে আছে হা করে, শুধু একবার ভূ-প্রকৃতিতে সামান্য পরিমাণে আলোড়ন বা ইমব্যালান্স হবে আর চলন্ত গাড়ির দিকে অসংখ্য পাথর গড়িয়ে পড়বে । সেই সাথে আমাদের গাড়ি হারিয়ে যাবে পাথুরে গভীর খাদে । এসব পাথর দেখে এমনই মনে হচ্ছিলো বারবার ।

এই পথেই রয়েছে ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম মটোরেবল পাস, যার নাম Chang La Pass.(Height 17688ft or 5360m). লেহ থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে এই চ্যাংলা পাসের অবস্থান । কিছু কিছু জায়গায় এটাকে ভারতের সর্বোচ্চ পাসের খেতাবও দেয়া আছে খেয়াল করেছি । তবে অনেক জায়গায় ভারতের সর্বোচ্চ পাস হিসেবে Khardung La  Pass এর নামও উঠে এসেছে ।  আমি এসব নিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাটি করে দেখেছি, খালি কনফিউজড হয়ে যাই । র‍্যাংকিং এ কোন পাসের অবস্থান কততম, সেটা দেখি মাঝে মাঝেই চেঞ্জ হয় । তা না হলে বিভিন্ন জায়গায় লিখিত এসবের হাইটের তারতম্য দেখা যেতো না । তবে সর্বোচ্চ পাসের বিবেচনায় ভারতের উত্তরাখাণ্ড এবং সিকিমের নামটা উঠে এলেও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাস রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের দখলেই । পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ কিছু মটোরেবল পাসের দেখা পাওয়া যাবে এসব জায়গায় । আর এসব জায়গায় পদচিহ্ন ফেলে আসাটাও আলাদা একটা ভালোলাগার বিষয় বলে মনে হয়, একটা ছোট্ট অর্জন বলে মনে হয় ।


যাহোক, বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বাস গিয়ে পৌঁছায় চ্যাংলা পাসে । ছোট্ট একটা বিরতি দেয় সেখানে । আমরা বাস থেকে নেমে চারিদিকটা দেখি কিছুক্ষণ । যতদূর চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ । আর কি ঠাণ্ডা বাতাস, জমে যাচ্ছিলাম ঠাণ্ডায় । দুই বন্ধু গিয়ে হুটহাট কিছু ফটো তুলে নিলাম ।
চ্যাংলা পাস

চ্যাংলা পাস

একটা বিষয় একটু খারাপ লাগলো সত্যি বলতে । এরকম একটি বরফের রাজ্যে যতটা পরিচ্ছন্নতা আশা করা যায়, ততোটা ছিলো না । মানুষজন দিনদিন জায়গাগুলো নোংরা করে ফেলছে । আমি মনে করি যারা মনেপ্রাণে ভ্রমণ ভালোবাসে এবং একইসাথে ননসেন্স না, তারা কখনো বেড়াতে গিয়ে কোন জায়গা নোংরা করে না ।


সকাল সাতটার দিকে রওনা দিয়ে প্যাংগং লেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের বেলা আড়াইটা বেজে যায় । ইন দ্যা মিনটাইম, পথে তিনবার বিদেশীদের পাসপোর্ট এবং অনুমতিপত্র চেক করা হয় এবং কয়েকবার যাত্রাবিরতি দেয়া হয় । পথের দৃশ্যগুলো এতোটাই ভালোলাগছিলো যে বরাবরের মতোই ভ্রমণের ক্লান্তি আর গায়েই লাগছিলো না । পাহাড়ের গা বেয়ে চলা বন্ধুর পথ... কখনো কখনো শুধু পাথরের পাহাড়, কখনোবা শুধুই বরফের । অন্যরকম একটা ভালো লাগা মিশে ছিলো সেখানে ।


প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে

প্যাংগং এর পথে
সবার সাথে বেশ সখ্যতা হয়ে গেছে এই জার্নিতে । সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছি বাসে । শুধু ইংল্যাণ্ডের ওই বৃদ্ধ দম্পত্তিকে দেখলাম একটু একলা থাকতে ভালোবাসেন বোধহয় । তাই তাদের সাথে আর কথা বাড়াইনি । কিন্তু ওভারল আমাদের বাসের ভেতরে কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছিলো আমরা সবাই যেনো পুরানো বন্ধু । একসাথে একটা বাস রিজার্ভ নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছি ।

আমি তো ভ্রমণের একটা বড় সময় ড্রাইভার মামার পাশের সিটে শুয়ে শুয়ে এসেছি । সেখানে অনেক্ষণ ধরে একটা মেয়েকে দেখলাম বসে আছে । বাড়ি রাজস্থানে । মেয়েটার নাম - "প্রাচী ঢাকা" । আমরাও ঢাকা থেকে গিয়েছি । সুতরাং এটা নিয়েই কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম । খুব পটেনশিয়াল লেডি মনে হলো । দিল্লিতে কোন একটা রেপুটেড ইন্সটিটিউশনে চারুকারু রিলেটেড কোন একটা বিষয়ে পড়াশোনা করে এবং নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই প্যাশনেট সে । অনেক্ষণ একসাথে এসেছি, বহু গল্প হলো একসাথে । বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হলেও অনেক কিছু শেখার ছিলো । বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল । সে প্যাংগং তার বাবার কাছেই যাচ্ছিলো । যাহোক, এভাবেই গল্পে গল্পে পথ ফুরিয়ে এলো । প্রাচীও নেমে গেলো । আমরাও প্যাংগং এর কাছাকাছি চলে এলাম । দূরে থেকেই প্যাংগং দেখেই আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো ।



প্যাংগং লেকঃ 


প্যাংগং নিয়ে কিছু বিষয় জানার আছে । এটা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৪,৩৫০মিটার (১৪,২৭০ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত, যেখানে আমাদের বগালেকের উচ্চতা হলো ৩৮০ মিটার (১,২৪৬ ফুট) । এতো উচ্চতায় অবস্থিত এতো বিশাল জলাধার গোটা পৃথিবীতে খুব কমই আছে । প্যাংগং তার মাঝে অন্যতম । দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৩৪ কিলোমিটার লম্বা এই লেকটির ৬০ ভাগ পড়েছে চীনের তিব্বতের মধ্যে আর বাকি ৪০ ভাগ রয়েছে ভারতের লাদাখে । এই লেকের মধ্যে দিয়েই চলে গেছে সেই বিখ্যাত চাইনিজ-ইন্ডিয়ার সীমারেখা - লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল । লেকের সর্বোচ্চ প্রস্থ ৫ কিলোমিটার । প্রায় ৬০৪ বর্গকিলোমিটারের একটি এলাকা জুড়ে এই লেকটির অবস্থান । এর পানি সবসময় খুবই শীতল থাকে । লবণাক্ত পানি হওয়া স্বত্বেও শীতে পুরো লেকের উপরিভাগের পানি একদম ফ্রিজ হয়ে যায় । আমরা গিয়ে শুনি শীতে স্থানীয় ছেলেরা নাকি লেকের উপরে ক্রিকেট খেলে । এটা কোন ইন্টারকানেক্টেড জলাধার না । এটা সম্পূর্ণ বদ্ধ, এর সাথে কোনভাবেই কোন নদী বা সমুদ্রের সংযোগ নেই । It's nothing but a  geographically separate landlocked river basin. 

প্যাংগং লেক 


প্যাংগং লেক 
খুব সেন্সিটিভ একটা একালায় এর অবস্থান । অবস্থান এর বর্ণনা শুনেই বুঝতে পারার কথা । এখানেও ভারতীয় আর্মির ছড়াছড়ি । সবসময় পরিবেশের মাঝে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব । ওইপাশে চীন, এপাশে ভারত । এখানে এসে উলটাপালটা কিছু করার আগে সবাইকে কয়েকবার ভাবতে হবে । 












মন্তব্যসমূহ

  1. প্যাংগং লেক এ যাওয়ার পারমিশন কিভাবে পেলেন, জানালে উপকৃত হতাম।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব সাবলীলএকটি লিখা।আগামী ঈদুল ফিতরের সময় যেতে চাই।আপনার সহযোগীতা চাইব তখন।একেবারে আপনার রুটেই।ধন্যবাদ ভাই।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কম খরচে কাশ্মীর-লাদাখ-মানালি ভ্রমণ

১০৫০ টাকায় ঢাকা থেকে চারদিনের রাজশাহী+নওগাঁ সফর

কম খরচে সিমলা-মানালি ভ্রমণ