 |
| প্যাংগং এর পাড়ে আমরা দুই বন্ধু |
গন্তব্য প্যাংগং লেকঃ (০৯/০৬/১৯)
পরদিন একদম সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দুই বন্ধু চলে গেলাম লেহ বাসস্ট্যাণ্ডে । টিকিট কাউন্টার তখনো খোলেনি । দুই বন্ধু গিয়েই দেখি আর্জেন্টাইন এক কাপল বসে আছে সেখানে । কথায় কথায় জানতে পারলাম তারাও প্যাংগং লেক যাবে এবং বাসের জন্য অপেক্ষা করছে । কথাবার্তায় বেশ আন্তরিক মনে হলো । সেখানেই দেখলাম একটা ছোট হোটেল ছিলো । সেখানেই আমরা আমাদের ব্রেকফাস্ট সারলাম এবং কিছু এক্সট্রা খাবার কিনে নিলাম ।
 |
| লেহ বাসস্ট্যাণ্ডের বিপরীত দিকের ভিউ |
ব্রেকফাস্ট সেরে এসে দেখি আরেকজন মেক্সিকান এসে হাজির । আর্জেন্টাইন দুইজন আর মেক্সিকান টা বসে গল্প করছে । আমরা দুইজন জয়েন করলাম তাদের গল্পে । আর্জেন্টাইন দুইজনের নাম মাতিয়াস আর জুলিয়েট, মেক্সিকান টার নাম ছিলো ইভান । বেশ আড্ডা দিলাম । এরপরে টিকিট কাউন্টার ওপেন হলে গিয়ে নিজেদের টিকিট সংগ্রহ করলাম । ভেবেছিলাম অনেক কম্পিটিটর থাকে হয়তোবা, পরে গেলে যদি টিকিট না পাই... কিন্তু বুঝলাম আসলেও সেরকম ভীড় নাই ।
টিকিট নিয়ে বাসে উঠে বসলাম । আজকের বাসটাও গতদিনের সেই শ্রীনগর-লেহ রুটের বাসের মতোই । বাসে উঠেই দেখি আরো কিছু বিদেশী নাগরিক বাসে বসে আছেন । আজকে যতদূর মনে পড়ে সেখানে উপস্থিতিদের মধ্যে ছিলো -
ইংল্যাণ্ডের এক বৃদ্ধ দম্পতি, স্পেনের এক ভদ্রমহিলা, আর্জেন্টাইন কাপল, একজন মেক্সিকান, রাজস্থানের একটা মেয়ে, দক্ষিণ ভারতের দুই বন্ধু, ন্যাটিভ একজন মহিলা এবং দুইটা ছেলে...
আপাতত আর মনে পড়ছে না । সেই জার্নিতে সবার সাথে এতো আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিলো যে আজকে ৫ মাস পরে লিখতে বসেও মোটামুটি ২-৪ জন বাদে সবার কথাই মনে আছে । এমনকি ড্রাইভার আংকেলের সাথেও আমার বেশ সখ্যতা হয়ে গিয়েছিলো ।
বাসে উঠেই দেখলাম সবাই নিজ নিজ আসনে বসে আছে । আমরাও নিজেদের আসন গ্রহণ করলাম । সকাল সাতটার দিকে বাস মুভ করা শুরু করলো । বাস কিছুক্ষণ মোটামুটি সমতল ধরেই চললো । একটা সময় পরে গিয়ে খেয়াল করলাম বাস এখন পাহাড়ের গা বেয়ে চলা শুরু করেছে । কি রাস্তা রে ভাই । গতদিনের শ্রীনগর-লেহ রোডের চেয়েও এক্সট্রিম । মনে হয় গড়িয়ে পড়ার আশা নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে অসংখ্য বড় বড় পাথর তাকিয়ে আছে হা করে, শুধু একবার ভূ-প্রকৃতিতে সামান্য পরিমাণে আলোড়ন বা ইমব্যালান্স হবে আর চলন্ত গাড়ির দিকে অসংখ্য পাথর গড়িয়ে পড়বে । সেই সাথে আমাদের গাড়ি হারিয়ে যাবে পাথুরে গভীর খাদে । এসব পাথর দেখে এমনই মনে হচ্ছিলো বারবার ।
এই পথেই রয়েছে ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম মটোরেবল পাস, যার নাম Chang La Pass.(Height 17688ft or 5360m). লেহ থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে এই চ্যাংলা পাসের অবস্থান । কিছু কিছু জায়গায় এটাকে ভারতের সর্বোচ্চ পাসের খেতাবও দেয়া আছে খেয়াল করেছি । তবে অনেক জায়গায় ভারতের সর্বোচ্চ পাস হিসেবে Khardung La Pass এর নামও উঠে এসেছে । আমি এসব নিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাটি করে দেখেছি, খালি কনফিউজড হয়ে যাই । র্যাংকিং এ কোন পাসের অবস্থান কততম, সেটা দেখি মাঝে মাঝেই চেঞ্জ হয় । তা না হলে বিভিন্ন জায়গায় লিখিত এসবের হাইটের তারতম্য দেখা যেতো না । তবে সর্বোচ্চ পাসের বিবেচনায় ভারতের উত্তরাখাণ্ড এবং সিকিমের নামটা উঠে এলেও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাস রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের দখলেই । পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ কিছু মটোরেবল পাসের দেখা পাওয়া যাবে এসব জায়গায় । আর এসব জায়গায় পদচিহ্ন ফেলে আসাটাও আলাদা একটা ভালোলাগার বিষয় বলে মনে হয়, একটা ছোট্ট অর্জন বলে মনে হয় ।
যাহোক, বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বাস গিয়ে পৌঁছায় চ্যাংলা পাসে । ছোট্ট একটা বিরতি দেয় সেখানে । আমরা বাস থেকে নেমে চারিদিকটা দেখি কিছুক্ষণ । যতদূর চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ । আর কি ঠাণ্ডা বাতাস, জমে যাচ্ছিলাম ঠাণ্ডায় । দুই বন্ধু গিয়ে হুটহাট কিছু ফটো তুলে নিলাম ।
 |
| চ্যাংলা পাস |
একটা বিষয় একটু খারাপ লাগলো সত্যি বলতে । এরকম একটি বরফের রাজ্যে যতটা পরিচ্ছন্নতা আশা করা যায়, ততোটা ছিলো না । মানুষজন দিনদিন জায়গাগুলো নোংরা করে ফেলছে । আমি মনে করি যারা মনেপ্রাণে ভ্রমণ ভালোবাসে এবং একইসাথে ননসেন্স না, তারা কখনো বেড়াতে গিয়ে কোন জায়গা নোংরা করে না ।
সকাল সাতটার দিকে রওনা দিয়ে প্যাংগং লেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের বেলা আড়াইটা বেজে যায় । ইন দ্যা মিনটাইম, পথে তিনবার বিদেশীদের পাসপোর্ট এবং অনুমতিপত্র চেক করা হয় এবং কয়েকবার যাত্রাবিরতি দেয়া হয় । পথের দৃশ্যগুলো এতোটাই ভালোলাগছিলো যে বরাবরের মতোই ভ্রমণের ক্লান্তি আর গায়েই লাগছিলো না । পাহাড়ের গা বেয়ে চলা বন্ধুর পথ... কখনো কখনো শুধু পাথরের পাহাড়, কখনোবা শুধুই বরফের । অন্যরকম একটা ভালো লাগা মিশে ছিলো সেখানে ।
 |
| প্যাংগং এর পথে |
সবার সাথে বেশ সখ্যতা হয়ে গেছে এই জার্নিতে । সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছি বাসে । শুধু ইংল্যাণ্ডের ওই বৃদ্ধ দম্পত্তিকে দেখলাম একটু একলা থাকতে ভালোবাসেন বোধহয় । তাই তাদের সাথে আর কথা বাড়াইনি । কিন্তু ওভারল আমাদের বাসের ভেতরে কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছিলো আমরা সবাই যেনো পুরানো বন্ধু । একসাথে একটা বাস রিজার্ভ নিয়ে ভ্রমণে বের হয়েছি ।
আমি তো ভ্রমণের একটা বড় সময় ড্রাইভার মামার পাশের সিটে শুয়ে শুয়ে এসেছি । সেখানে অনেক্ষণ ধরে একটা মেয়েকে দেখলাম বসে আছে । বাড়ি রাজস্থানে । মেয়েটার নাম - "প্রাচী ঢাকা" । আমরাও ঢাকা থেকে গিয়েছি । সুতরাং এটা নিয়েই কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম । খুব পটেনশিয়াল লেডি মনে হলো । দিল্লিতে কোন একটা রেপুটেড ইন্সটিটিউশনে চারুকারু রিলেটেড কোন একটা বিষয়ে পড়াশোনা করে এবং নিজের পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই প্যাশনেট সে । অনেক্ষণ একসাথে এসেছি, বহু গল্প হলো একসাথে । বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হলেও অনেক কিছু শেখার ছিলো । বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল । সে প্যাংগং তার বাবার কাছেই যাচ্ছিলো । যাহোক, এভাবেই গল্পে গল্পে পথ ফুরিয়ে এলো । প্রাচীও নেমে গেলো । আমরাও প্যাংগং এর কাছাকাছি চলে এলাম । দূরে থেকেই প্যাংগং দেখেই আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো ।
প্যাংগং লেকঃ
প্যাংগং নিয়ে কিছু বিষয় জানার আছে । এটা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৪,৩৫০মিটার (১৪,২৭০ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত, যেখানে আমাদের বগালেকের উচ্চতা হলো ৩৮০ মিটার (১,২৪৬ ফুট) । এতো উচ্চতায় অবস্থিত এতো বিশাল জলাধার গোটা পৃথিবীতে খুব কমই আছে । প্যাংগং তার মাঝে অন্যতম । দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৩৪ কিলোমিটার লম্বা এই লেকটির ৬০ ভাগ পড়েছে চীনের তিব্বতের মধ্যে আর বাকি ৪০ ভাগ রয়েছে ভারতের লাদাখে । এই লেকের মধ্যে দিয়েই চলে গেছে সেই বিখ্যাত চাইনিজ-ইন্ডিয়ার সীমারেখা - লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল । লেকের সর্বোচ্চ প্রস্থ ৫ কিলোমিটার । প্রায় ৬০৪ বর্গকিলোমিটারের একটি এলাকা জুড়ে এই লেকটির অবস্থান । এর পানি সবসময় খুবই শীতল থাকে । লবণাক্ত পানি হওয়া স্বত্বেও শীতে পুরো লেকের উপরিভাগের পানি একদম ফ্রিজ হয়ে যায় । আমরা গিয়ে শুনি শীতে স্থানীয় ছেলেরা নাকি লেকের উপরে ক্রিকেট খেলে । এটা কোন ইন্টারকানেক্টেড জলাধার না । এটা সম্পূর্ণ বদ্ধ, এর সাথে কোনভাবেই কোন নদী বা সমুদ্রের সংযোগ নেই । It's nothing but a geographically separate landlocked river basin.
 |
| প্যাংগং লেক |
খুব সেন্সিটিভ একটা একালায় এর অবস্থান । অবস্থান এর বর্ণনা শুনেই বুঝতে পারার কথা । এখানেও ভারতীয় আর্মির ছড়াছড়ি । সবসময় পরিবেশের মাঝে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব । ওইপাশে চীন, এপাশে ভারত । এখানে এসে উলটাপালটা কিছু করার আগে সবাইকে কয়েকবার ভাবতে হবে ।
প্যাংগং লেক এ যাওয়ার পারমিশন কিভাবে পেলেন, জানালে উপকৃত হতাম।
উত্তরমুছুনখুব সাবলীলএকটি লিখা।আগামী ঈদুল ফিতরের সময় যেতে চাই।আপনার সহযোগীতা চাইব তখন।একেবারে আপনার রুটেই।ধন্যবাদ ভাই।
উত্তরমুছুন