ত্রয়োদশ পর্বঃ লাদাখের পথে - ২
লেহ শহরের অদূরে |
কার্গিল থেকে লেহ অভিমুখেঃ(০৮/০৬/১৯)
৮ জুলাই ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠলাম সবাই । উঠেই ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম নীচে । এরপরে একদম যথাসময়ে বাস ছেড়ে গেলো লেহ অভিমুখে । আজকের গল্প আর খুব বেশি নেই সত্যি বলতে । শুধুই ছুটে চলা আর কি । ততোক্ষণে বাসের সবার মাঝে একটা হৃদ্যতা চলে এসেছে । কলকাতার তিন আংকেল তো একপ্রকার আমাদের বৃদ্ধ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে । তাদের সাথে মিশে সত্যিই খুব ভালো লেগেছে । এই বয়সে এসে নিজেদের জন্য এভাবে সময় বের করা নিশ্চয়ই কোন সহজ কাজ না । কিন্তু তারা এই কাজটাই কিভাবে যেনো সহজ করে ফেলেছেন । অনুপ্রাণিত হয়েছি তাদের দ্বারা ।
সত্যি বলতে এরকম বাল্যবন্ধুকে ট্রাভেল পার্টনার হিসেবে পাওয়াটা সৌভাগ্যের একটি বিষয় । আমি তবু সুফলকে পেয়েছি, কারো কারো তো সেটাও নেই । আমরা দুইজন মিলে ঘুরে বেড়ানোকেই নাম দিয়েছি - সোলো ট্রিপ । মানে দুইজন মিলেই একজন ।
উঁচু-নিচু কখনো বন্ধুর, কখনো মসৃণ পথ ধরে চলতে লাগলো আমাদের বাস । অসম্ভব ভালো লাগছিলো । একটা মূহুর্তও অন্যকাজে ব্যয় করতে ইচ্ছে করছিলো না। সারজীবন পিকচারে দেখে এসেছি এসব ভিউ । কেমন ধূসর চারিদিকে, কোন গাছপালা নেই, এই জায়গাগুলো কেনো মানুষের কাছে এতো প্রিয় - মাথায় আসতো না । সেই মানুষের ক্রেজের কারণ অন্বেষণেই আমাদের পথে নামা । সত্যিই লাদাখে বেড়িয়ে আমার একটাই কথা মনে হয়েছে , সেটা হলো লাদাখের পিক দেখে কিছুই ফিল করা যায় না । এজন্য স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে সেখানে । জীবনের অন্যতম সেরা মেমোরি হিসেবে বিবেচিত হবে এই লাদাখ সফর । আমার কাছে লাস্ট কয়েক মাস ধরে কেউ কোন ট্যুরের সাজেশন চাইলেই আমি একবাক্যে বলি লাদাখ যাও । কেউ সমুদ্র দেখতে চাইলেও তাকে লাদাখ যেতে বলি, কেউ ইংল্যাণ্ডে বেড়াতে যেতে চাইলেও তাকে লাদাখ যেতে বলি । লাদাখ হলো সারাজীবন দেখা সকল সুন্দর থেকে আলাদা কিছু । এজন্যই এটা সেন্স অব বিউটির ক্ষেত্রে আলাদা একটা ডাইমেনশন ক্রিয়েট করতে পেরেছে ।
যাহোক, সকাল নয়টার দিকে পথিমধ্যে একজায়গায় বাস থামায় । সেখানে নেমে আমরা ব্রেকফাস্ট করি । অল্প খরচেই বেশ পেট পুরে খাবার পাই । কার্গিল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে নামিকা লা পাসের অবস্থান, সেখানে থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে ফতু লা পাসের অবস্থান । এই দুইটা এই রুটের অন্যতম বিখ্যাত সর্বোচ্চ উচ্চতার মোটরযান চলাচল উপযোগী পাস । সত্যি বলতে আমরা আগে থেকেই এই পাস দুইটা সম্পর্কে ততোটা জানতাম না । পরবর্তীতে জানতে পারি যে এই রুটে এই পাস দুইটা পরে ।
যাহোক, ফতু লা পাস থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে Magnetic Hill এর অবস্থান । ম্যাগনেটিক হিলের বিষয়টা আমার কাছে বেশ মজার এবং রহস্যময় লেগেছে । এখানে আসার পরে অটোমেটিক গাড়ির গতি নাকি কমে যায় । সমতল রাস্তা হওয়া স্বত্বেও আমাদের গাড়ির গতি যথেষ্ট শ্লথ ছিলো এখানে ।
![]() |
ম্যাগনেটিক হিল |
ম্যাগনেটিক হিলের এরিয়া টা একদম ছোটও না । এখানে গ্রাভিটির বাইরে কিছু কাজ হয় । যেমন গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখলেও নাকি একটা ধীরে ধীরে আপহিলের দিকে চলতে শুরু করে এবং সেটা ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে পারে । Mysterious ! এমন কি এই এরোপ্লেন এসব ঝামেলা এড়ানোর জন্য এই এলাকায় অনেক উপরে দিয়ে উড্ডয়ন করে নাহলে এই একালাই স্কিপ করে যায় ।
ম্যাগনেটিক হিল থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লেহ শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর একটা বেজে যায় । আহ সেই বহুল আকাঙ্খিত গন্তব্য লেহ সিটি । অবশেষে শ্রীনগর থেকে দুইদিনব্যাপী আমাদের ভ্রমণের ইতি হলো । আগেরদিন কার্গিলে পৌঁছে যেমন কিছুটা কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, আজকে সেরকম কিছুই ফিল হলো না । I was completely okay. গতদিন তাহলে হয়তোবা অন্য কোন কারণে কিছুটা অসুস্থ বোধ করেছিলাম । যাহোক, ভালোই হলো । বিদেশী সকলের থেকে বিদায় নিলেও কলকাতার তিন আংকেলের সাথে এটাচড ছিলাম আমরা দুইজন । লেহ তে পৌঁছে বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই । এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য নুব্রা ভ্যালী, প্যাংগং লেক এবং তুরতুক ভিলেজের জন্য অনুমতি জোগাড় করা । যদিও জানতাম এটা অসম্ভব একটি ব্যাপার, তবুও দেখা যাক কপালে কি আছে !
Inner Line Permit for Pangong Lake:
বাস থেকে নেমে সরাসরি চলে গেলাম লেহ জেলার ডিসি অফিসে । ডিসি অফিসে গিয়েই দেখলাম দরজার পাশে নোটিশ টানানো আছে । যেখানে বলা আছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান এবং হংকং এর নাগরিকদের লেহ সিটির বাইরে ভ্রমণের জন্য প্রবেশাধিকার নেই। এই কয় দেশের নাগরিকদের নুব্রা ভ্যালী, প্যাংগং লেক, তুরতুক ভিলেজ ভ্রমণের ইচ্ছে থাকলে তাদেরকে দিল্লি হোম এফেয়ার্স থেকে অনুমতি নিতে হবে। বলে রাখা ভালো, এই অনুমতি খুব বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়া সাধারণদের নাগালের বাইরে ৷
![]() |
নিষেধাজ্ঞার নোটিশ |
As expected ! যেমন ভেবেছিলাম, তেমনই হলো । এখন চেষ্টা, এর বাইরে কিছু করা যায় নাকি । প্রায় ঘণ্টা তিনেক কাজ করার পরে আমরা আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হলাম । বাংলাদেশী নাগরিক হয়েও পেয়ে গেলাম স্পেশাল পারমিশন ।
স্পেশাল পারমিশন লেটার |
![]() |
VICTORY |
এটা পেয়ে দুই বন্ধুর খুশি দেখে কে । Achievement Unlocked... খুব হালকা বোধ হচ্ছিলো সত্যি বলতে । যদিও তুরতুক ভিলেজ এবং নুব্রা ভ্যালীর জন্যও কিছুটা আফসোস ছিলো, তবুও সেটাকে আর আমলে না নিয়ে যা পেয়েছি তার জন্যই শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম ।
শুরুতেই ক্ষমাপ্রার্থনা করছি । আমি জানি অনেকে এই ব্লগ পড়ছেন বা ব্লগের শুধুমাত্র এই পর্বটাই পড়ছেন এটা জানার আশায় যে আমরা আসলে ঠিক কিভাবে অনুমতি ম্যানেজ করলাম। তাদেরকে আমি হতাশ করছি আপাতত । আমি এখন বলতে চাইনা কিভাবে অনুমতি পেলাম । তবে নিজের একটা মতামত শেয়ার করছি । যে প্রসেসের মধ্যে দিয়ে আমাদের অনুমতি ম্যানেজ করতে হয়েছে, আগে থেকে সেই ব্যাপারে আইডিয়া থাকলে হয়তোবা আমরা এসব ঘোরার প্ল্যান নিয়ে লাদাখ যেতাম না । তবে হ্যাঁ, আপনারা লাদাখে অবশ্যই যেতে পারেন । লাদাখে ঘোরার অনুমতি না পেলেও এইযে শ্রীনগর-লেহ-মানালি যে রোড ট্রিপ টা, সেটা সারাজীবন মনে রাখার মতো । শুধু এই রোড ট্রিপের জন্যই বারবার লাদাখে আসতে পারেন আপনি । তবে ভবিষ্যতে কোনদিন যদি শুনি যে লাদাখেবাংলাদেশীদের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়েছে, তাহলে আমি নিজেই আগে যাবো সেখানে । এজ ওয়েল এজ, আপনারাও যাবেন অবশ্যই ।
বলে রাখি, আমরা যে প্রসেসে প্যাংগং এর অনুমতি পেয়েছি, সেটা আগে থেকে জেনে গেলে সুবিধা হবে - এমন না । ইন্সট্যান্ট এপ্লাই করার মতো ব্যাপার । বলতে পারেন এটাই শেষ বুদ্ধি । সুতরাং এতো কিছুর পরেও যদি আপনার প্যাংগং ঘোরার পোকা থেকেই যায়, আপনি লেহ তে গিয়ে আমাকে নক দিয়েন । আমি আপনাকে আমাদের সিস্টেম টা শিখিয়ে দেবো । এতে করে কাজ হলে হবে, নাহলে ধরেই নেবেন এজ এক্সপেক্টেড । এই বিষয় নিয়ে অনুগ্রহ করে আগেই আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না ।
যাহোক, এইসব কাজ করতে গিয়ে আমাদের খরচ হলো ৫২৫ রুপী । অনুমতিপত্র হাতে নিয়ে খুশিমনে দুইজন লেহ শহর হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। প্রথমেই যে হোটেলে গেলাম, ২ জনের জন্য ৩০০ রুপী ভাড়া চাইলো । বাহ । বেশ তো, যেমন বাজেটের পর্যটক আমরা, তাদের জন্য একদম পারফেক্ট । কথা না বাড়িয়ে নিয়ে নিলাম । ৩০০ টাকার হোটেল রুমের আর কি বর্ণনা দেবো বলুন । ছোট্ট একটা কক্ষ, দুইটা চৌকি, একটা সাধারণ মানের কমন বাথরুম... এইতো । আমাদের দুইজনের জন্য যথার্থ ছিলো ।
হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে সেই তিন আংকেলের সাথে দেখা করতে গেলাম । সেই তিনজন আমাদের পাশের আরেকটা হোটেলে উঠেছিলেন । আমরা প্যাংগং এর অনুমতি পেয়েছি শুনে তারাও বেশ আপ্লুত হলেন । সমস্যা হলো আরেক জায়গায় । আমাদের প্ল্যান ছিলো সবাই একসাথে প্যাংগং যাবো । কিন্তু ওনারা তখনো অনুমতি না নিয়ে বিশ্রাম করছিলেন । ওনারা জানতেন না যে চারটার পরে আর অনুমতি দেয় না । পরে সেদিন আর তারা অনুমতি নিতে পারলেন না । ব্যস বাধ্য হয়েই আমাদের আর একসাথে যাওয়া হলো না । যাহোক, তাদের আবাসিক হোটেলের সাথেই এটাচড ভালো একটা খাবার হোটেল ছিলো । সেখানেই সন্ধ্যার সময় দুই বন্ধু বসে খাওয়া-দাওয়া করলাম । খাওয়া-দাওয়ার অনিচ্ছাকৃত কিছু অনিয়ম হলেও সেই সুবাদে সত্যি বলতে কিছু টাকাও সেভ হচ্ছিলো । তবে এর মানে এই না যে আমরা না খেয়ে কষ্ট করে ঘুরে টাকা সেভ করেছি শুধু । খাওয়া-দাওয়া করে নিজেদের হোটেলে চলে এলাম আমরা দুইজন । এসে আগামীদিনের প্ল্যান ফিক্সড করে ঘুমিয়ে গেলাম ।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আমরা লাদাখের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে শুধু ট্যাক্সিই আছে বলে জানতাম, তাই খরচও অনেক বলে ভেবেছিলাম । সত্যি বলতে ট্যাক্সি নিলে খরচ অনেকই হয় । প্যাংগং লেক, নুব্রা ভ্যালী বা তুরতুক... প্রতি স্পটের জন্য রিজার্ভ ট্যাক্সি প্রায় ৮-৯০০০ রুপী লেগেই যায় । শেয়ারড ট্যাক্সিও আছে, তবে খোঁজ নিতে হবে । আমরা আগে থেকেই জানতাম যে এসব জায়গায় লেহ সিটি থেকে বাসও চলে, কিন্তু একটু কনফিউজড ছিলাম । ওখানে গিয়ে দেখলাম যে নাহ বেশ ভালোভাবেই বাস চলে লাদাখের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটের দিকে । তাই খরচের ব্যাপারে একদম রিলাক্স ফিল করছিলাম । লেহ বাসস্ট্যাণ্ডে বিভিন্ন স্পটের দূরত্ব, ভাড়া, অফ ডে, ছাড়ার সময়ের তালিকা সম্বলিত একটা সাইনবোর্ড আছে ।
![]() |
লেহ বাসস্ট্যাণ্ড থেকে তোলা |
তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম । এই চার্ট অনুযায়ী লেহ থেকে শ্রীনগরের ভাড়া ১২০৩ রুপী । কিন্তু শ্রীনগর থেকে লেহ এর ভাড়া ৯০০ রুপী । ড্রাইভার চাচাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম এর কারণ । কি রিপ্লাই দিয়েছিলেন তা আজকে আর মনে করতে পারছি না ।
লেহ থেকে প্রতি মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং রবিবার সকাল সাড়ে ছয়টায় প্যাংগং লেকের দিকে JKSRTC এর বাস ছেড়ে যায়, দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার এবং ভাড়া জনপ্রতি ২৯২ রুপী (ওয়ান ওয়ে) । সেই একই বাস এক রাত প্যাংগং এ থেকে পরদিন সকালে লেহ সিটি অভিমুখে রওনা হয় । আপ-ডাউন জনপ্রতি ভাড়া লাগে ৫৮৪ রুপী ।
আজকের খরচঃ (০৮/০৬/১৯)
১। পারমিশন = ৫২৫/-
২। খাওয়া = ৩৮৫/-
৩। হোটেল ভাড়া = ৩০০/-
মোটঃ ১২১০ রুপী
Vhai permission kivabe manage korlen ta jodi share korten tahole khob vhalo hoto.
উত্তরমুছুনপারমিশন কিভাবে সংগ্রহ করলেন একটু বলেন ভাই, প্লিজ।এই জুলাইয়ে যাচ্ছি।প্লিজ ভাই
উত্তরমুছুন