অষ্টম পর্বঃ অপরিচিতা দুধপত্রী(Doodhpothry)
![]() |
Doodhpothry |
আজকের সকালঃ (০৪/০৬/১৯)
শুরু হলো আরেক কনফিউজড দিনের গল্প । এলোমেলো চিন্তাভাবনা নিয়েই এগোতে লাগলো আমাদের এক্টিভিটি । কোন চিন্তাই ঠিক কাজের ছিলো না । তারউপরে ঘুম থেকে উঠলাম কিছুটা দেরিতেই । আজকে মূলত প্ল্যান ছিলো দুধপত্রী ঘোরার । কিন্তু এক্টিভিটি দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো আজকেও কোন কাজ নাই আমাদের ।
যাহোক, ধীরে সুস্থে উঠে ফ্রেশ হয়ে হাউজবোট থেকে চলে গেলাম ঘাটে । ভাই কিছু বকশিস চাইলো । দিলাম ৩০ টাকা । সেই টাকা গতদিনের হাউজবোটের ভাড়ার সাথে এড করে দিয়েছি । সেখানে থেকে আমাদের আগের দিনে ঠিক করে রাখা হোটেলে গিয়ে ব্যাগ রেখে সরাসরি TRC তে চলে গেলাম । ইন দ্য মিনটাইম অনেক সময় লেগে গেলো । ওভারল জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমের হেড অফিস হলো শ্রীনগর TRC. কিন্তু তাদের কথাবার্তা শুনে মনেই হলো না লাদাখের ট্যুরিজমের ব্যাপারে খুব একটা ওয়াকিবহাল তারা । আমরা যা অনেক আগে থেকেই জানতাম, সেসবই অনেক সময় নিয়ে লাদাখ TRC তে কথা বলে আমাদের জানালো তারা ।
সেখানে থেকে বের হতে হতেই বেলা প্রায় সাড়ে দশটা পার হয়ে গেলো । ব্রেকফাস্ট করে নিলাম । এরপরে যাবো দুধপত্রীর দিকে । সে এক বিশাল নাটক রে ভাই ।
দুধপত্রী তে লোকালি যাওয়া টাফ । সবাই বলে যাওয়া যায়, বাট আমরা যাবার সময় বুঝলাম লোকালি আসা বোকামি হয়ে গেলো । উচিত ছিলো খরচ কিছু বেশি হলেও রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে আসা । তার উপরে বের হতে হতে দেরি হয়ে গেলো । লালচক থেকে দুধপত্রী প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে । সরাসরি গেলে ঘণ্টা দেড়েক লাগে ।
অপরিচিতা দুধপত্রীঃ
এমন নামের প্রধান কারণ হলো এই ট্যুর স্পটটি কাশ্মীর ভ্রমণের অংশ হিসেবে বাহিরের মানুষের কাছে অনেকটাই অজানা । এরকম আরো অনেক জায়গাই আছে যেগুলো বাহিরের মানুষের কাছে ততোটা পরিচিত না যতটা সোনমার্গ, গুলমার্গ বা পেহেলগাম পরিচিত । যেমন - ইউশমার্গ, কাশ্মীর ভ্যালি, পুলওয়ামা, চেনাব ভ্যালি, উলার লেক সহ আরো অনেক জায়গা আছে । গুগল, ফেসবুক আর ইউটিউবে ঘেঁটে ঘেঁটে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দুধপত্রী জায়গাটা চয়েস করেছিলাম। এই দুধপত্রী শব্দের অর্থ হলো ভ্যালি অব মিল্ক । অবশেষে আমরা বেড়িয়ে দুধের ভ্যালি দেখতে ।
যাহোক, নাটক শুরু হলো । লালচক থেকে বাসে চেপে জনপ্রতি ৫ রুপী হারে নমস্ব নামে একটা জায়গায় গেলাম শুরুতে । সুফল বাসে চেপেই বলে বসলো - এই বাস কি নমস্কার যাবে নাকি ? বাসের যাত্রীরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলো । তখন বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে । সাথে সাথে বাকিরাই ঠিক করে দিলো । কাশ্মীরের সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে খুবই হেল্প করেছে আমাদের ।
নমস্ব নামলাম । এখন যাবো বাডগামে । বাডগাম মূলত একটা জেলার নাম, আর দুধপত্রী বাডগামের একটি দর্শনীয় স্থান । নমস্বতে বাডগামের আলাদা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড আছে । এই স্ট্যাণ্ড আর খুঁজে পাইনা । একেকজন একেদিকে যেতে বলে । প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তখন । একটা সুন্দরী কাশ্মীরি মেয়েকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - বাডগাম ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড টা কোন দিকে । সে ডিরেকশন দিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিলো । সুফলের কাছে গেলে বললো- দেখছিস মেয়েটা কি সুন্দর হাসি দিয়েছে। আমি সুফলকে বললাম - সে এই টর্চারটুকু না করলেও পারতো ।😄
যাহোক, অনেক ঝামেলার পরে বাধ্য হয়ে একটা অটো নিলাম ৫০ রুপী দিয়ে, যার কাজই হবে আমাদেরকে নমস্বতে অবস্থিত Budgam ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে নিয়ে যাওয়া । সে মিনিট চারেকের মাঝেই আমাদের এনে নামিয়ে দিলো জায়গামতো । আমরাও বাটগামের ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম । ভাড়া আগে থেকেই জিজ্ঞেস করা একপ্রকার অপ্রয়োজনীয় । কারণ ওরা ভাড়া বেশি রাখেনা। ওদের শিক্ষায় এটা নেই । অনেক জ্যাম পেরিয়ে, অনেক্ষণ পরে সে আমাদের এনে নামিয়ে দিলো বাডগামে । ভাড়া রাখলো দুজনের জন্য ৪০ রুপী ।
বাডগাম থেকে রাইদা নামে একটা জায়গার ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম । ভাড়া গেলো দুইজনের ৮০রুপী । রাইদা থেকে আরেকটা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেলাম মুশপত্রী নামের আরেকটা জায়গায় । ভাড়া গেলো দুইজনের ৪০ রুপী । বিকেল হয়ে গেছে । আমাদের গন্তব্য আর আসেনা রে ভাই । লোকালি এসে কি ভুল করেছি এবার টের পেলাম ।
![]() |
রাইদা থেকে মুশপত্রী যাবার পথে |
![]() |
ভেড়ার পালের রাস্তা পারাপার |
মুশপত্রী থেকে আরেকটা গাড়িতে উঠলাম যেটা আমাদের দুধপত্রী তে নামিয়ে দেবে । বিকেল হওয়ায় এখন গাড়ির সংখ্যা কমে যাচ্ছিলো । এই গাড়িতেই স্থানীয় কিছু কাশ্মীরির সাথে পরিচয় হলো আমাদের । বাংলাদেশী পরিচয় পেয়ে খুবই সমাদর করলো আমাদের । গাড়ির সবাই আমাদের দুইজনকে নিয়েই গল্পে মেতে উঠলো । বারবার বলছিলো কেনো এতো দেরি করে এলাম, এখানে তো বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। কারণ আমাদের সাথে রিজার্ভ গাড়িও নেই, আবার একটু পরে লোকাল গাড়িও আর মিলবে না । যাহোক, তারাই এই গাড়ির ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বললো যাতে সে আমাদের রেখে চলে না যায় । ড্রাইভার রাজি হলো । বাট বলে দিলো সেক্ষেত্রে যেনো বেশি দেরি না করি ।
দুধপত্রীতে যেখানে নামিয়ে দিলো সেখানে থেকে আরেকটু দূরে অবধি হেঁটে গেলে দেখা মেলে স্রোতস্বিনী শালিগঙ্গা নদীর । ট্যাক্সিতে করে আসা স্থানীয় একজন মুরুব্বী আমাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন শালিগঙ্গার ধারে । খুবই বিনয়ী একেকজন মানুষ ।
![]() |
দুধপত্রীতে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী শালিগঙ্গা |
![]() |
শালিগঙ্গার তীরে কাশ্মীরি এক মুরুব্বির সাথে |
আজকে এতো দেরিতে এতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে এসেছি আর এসেই এমন ফেরার তাড়া ছিলো যে, উপভোগ করার পর্যাপ্ত সময়ই পেলাম না। যাহোক, অল্প কিছু সময়ে যতটা দেখলাম তাতেই খুব ভালো লাগলো । সবুজের গালিচা, পাইনের বাগান, বয়ে চলা নদীর কুলুকুলু ধ্বনি মনকে প্রশান্ত করে দেয় একদম । কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে চলে গেলাম সেই ট্যাক্সির কাছে । তিনি আমাদের দুইজনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন । আমরা সেই কাশ্মীরি চাচাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম ।
![]() |
দুধপত্রীর পথে |
![]() | |
|
যে রুটে এসেছি, এবার আর সেই রুটে ব্যাক করলাম না। ভিন্ন একটা রুট ফলো করলাম । সেই ট্যাক্সি আমাদের এনে রাইয়ার নামে নতুন একটা জায়গায় নামিয়ে দিলেন । মুশপত্রী-দুধপত্রী-রাইয়ার রুটে তাকে ভাড়া দিলাম মোট ২৬০ রুপী । তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে । ২০ টাকা দিয়ে দুইজন চারটা কলা কিনে খেলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের গাড়ি চলে এলো । এখন আমরা রাইয়ার থেকে গেলাম খানসাহিব নামের একটা জায়গায় । ভাড়া দিলাম দুইজনে ৩০ রুপী । খানসাহিব গিয়ে দেখলাম শ্রীনগরের যাত্রী খুঁজতেছে ওখানকার লোকাল ট্যাক্সিওয়ালারা । আমরা উঠে বসলাম সেই ট্যাক্সিতে । চলে এলাম লালচক । খানসাহিব থেকে লালচক ভাড়া দিলাম মোট ১৪০ রুপী।লালচক থেকে দুজনে ১০ রুপীতে বাসে চেপে চলে এলাম ডালগেটে । তখনো সন্ধ্যা হয়নি । কি একটা জার্নি ছিলো রে ভাই । ইট ওয়াজ নট এক্সপেক্টেড রিয়েলি, বাট দ্য ট্রুথ ইজ ইট হ্যাপেণ্ড । হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম । এরপরে খাওয়ার জন্য বের হলাম দুইজন ।
রাস্তার পাশে দেখলাম কাশ্মীরি ওয়াজওয়ান বিক্রি হচ্ছে । দুইজনে খেলাম । খুবই ভালো লাগলো জিনিসটা । চানাচুর মাখানো খেলাম । এরপরে একটা হোটেলে ঢুকে মাটন বিরিয়ানি খেলাম দুইজন আরামে । খেয়ে দেয়ে এসে ডাললেকের ধারে বসে ছিলাম দুই বন্ধু অনেক্ষণ । দুইজন একসাথে নিরিবিলি বসলেই লাদাখের টপিক উঠে আসতো আমাদের মাঝে । খোঁচাখুচি শুরু হতো দুইজনের ।
তবুও এভাবেই চলছিলো । ডাললেকের ঘাটের সেই রাত, বিকাল বা সন্ধ্যাগুলো খুবই নির্মল ছিলো । একটা আলাদা ভালোলাগা মিশে রয়েছে সেখানে । কেমন একটা প্রশান্তি খুঁজে পেতাম জায়গাটাতে । যাহোক, পচ্চুর ভ্যালি অব দুধের সাগর ঘুরে আমরা যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়লাম । হোটেলে ফিরে গেলাম ।
হোটেলে ফিরে গিয়ে ফেসবুকে ঢুকে দেখি সমগ্র বাংলাদেশে একযোগে একটা নাটক চলছে, নাটকের নাম - "চাঁদ দেখা" । ভারত সরকার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে যে আগামীকাল ভারতে ঈদ-উল-ফিতর অনুষ্ঠিত হবে । কিন্তু বাংলাদেশের আকাশে নাকি তখনো চাঁদ দেখা যায়নি । বিদেশের মাটিতে বসে দুই বন্ধু দেশের এসব কেল্লা দেখছিলাম । যাহোক, একটা সময় বাংলাদেশের চাঁদ দেখা কমিটিও আগামীদিনে ঈদের ঘোষণা দিলো ।
প্রসঙ্গত, আগে থেকেই আমাদের প্ল্যানটা এমন ছিলো । আমরা জানতাম ঈদের দিনে কাশ্মীরের সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে । শুধু শ্রীনগর সিটিতে গাড়ি চলে । এজন্য আমরা ঈদের দিনটি রেখেছিলাম শ্রীনগর সিটি ট্রিপের জন্য । আর প্ল্যান ছিলো ঈদের নামাজ পড়বো সেই বিখ্যাত হযরত বাল মসজিদে । কথিত আছে সেখানে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দাঁড়ি মোবারক রাখা আছে ।
আজকের খরচঃ (০৪/০৬/১৯)
১। ব্রেকফাস্ট = ২২০ রুপী
২। লালচক - নমস্ব = ১০/-
৩। নমস্বতে বাডগাম ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড খোঁজা = ৫০/-
৪। নমস্ব-বাডগাম = ৪০/-
৫। বাডগাম-রাইদা = ৮০/-
৬। রাইদা - মুশপত্রী = ৪০/-
৭। মুশপত্রী-দুধপত্রী-রাইয়ার = ২৬০/-
৮। কলা = ২০/-
৯। রাইয়ার - খানসাহিব = ৩০/-
১০। খানসাহিব - লালচক = ১৪০/-
১১। লালচক - ডালগেট = ১০/-
১২। কাশ্মীরি ওয়াজওয়ান = ৭০/-
১৩। চানাচুর = ৩০/-
১৪। ডিনার = ৩০০/-
১৫। হোটেল ভাড়া = ৪২৫/-
মোটঃ ১৭২৫ রুপী
vai hotel er name ki chilo?
উত্তরমুছুন